নিরন্তর পথচলার তিন দশক-বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস
নিরন্তর পথচলার তিন দশক
মনসুরুল আলম মনসুর

আজ ৫ জানুয়ারি। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিসের ৩০ তম প্রতিষ্ঠা দিবস। প্রতিষ্ঠা দিবসের এই আনন্দঘন লগ্নে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত সংগঠনের বর্তমান ও প্রাক্তন দায়িত্বশীল-কর্মী, শুভাকাক্সক্ষী-শুভানুধ্যায়ীসহ সর্বস্তরের ছাত্র-ছাত্রী ও দেশবাসীকে জানাই সংগ্রামী শুভেচ্ছা ও বিপ্লবী অভিনন্দন!

সংগ্রামী দেশবাসী, ১৯৯০ সালের ৫ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস। একটি চরম বৈরি সময়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল এই কাফেলা। দেশে তখন স্বৈরশাসকের রাজত্ব চলছিল। প্রায় সকল ধরণের রাজনৈতিক কর্মকাÐ সীমিত ছিল। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে। সেই কঠিন সময়ে শাসক নামধারী শোষকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কয়েকজন দুঃসাহসী তরুণ জড়ো হন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। তারা শপথ নেন জালিমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার, ঘোষণা দেন- আমরা নিরব হব না, নিস্তব্দ হব না, যতদিন আল-কুরআনকে সংবিধান পাব না।

ইতিমধ্যে প্রায় তিন দশক পার হয়ে গেছে। এই ত্রিশ বছরে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস বাংলাদেশ তথা বিশ্বব্যাপী একটি আদর্শ স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সূধি মহলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ছাত্র মজলিস প্রমাণ করেছে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি এবং মাদকমুক্ত ছাত্র রাজনীতি সম্ভব। ছাত্র মজলিস দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, দলীয় লেজুড়ভিত্তির বাহিরে মেধা ও চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়ে ছাত্র সমাজকে নেতৃত্ব দেয়া যায়।

এদেশে যেমন রাজনৈতিক দলের অভাব নেই, তেমনি ছাত্র সংগঠনেরও অভাব নেই। তবে একমাত্র ছাত্র মজলিসই দাবি করতে পারে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্বতা শুধুমাত্র নিজেরাই সংরক্ষণ করে। সংগঠন নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় বাহিরের কারও হস্তক্ষেপ লাগে না। শুধু ছাত্র মজলিসই বলতে পারে- আমরা বিশেষ কোন গোষ্ঠীর নয়, আমরা সবার। এদেশে একমাত্র ইসলামী ছাত্র মজলিসই ত্রিধারায় বিভক্ত ছাত্র সমাজকে একটি ফ্লাটফরমে ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ্য হয়েছে।

আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, অনেক স্বপ্ন এখনো অপূরণ রয়ে গেছে তবুও আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, বিগত ত্রিশ বছরে ছাত্র মজলিস এমন কিছু মানুষ জাতিকে উপহার দিতে পেরেছে- যারা যোগ্যতা, দক্ষতা ও আপোসহীনতায় সর্বমহলে সমাদৃত। ইসলামী ছাত্র মজলিসের হাত ধরে তৃণমূল থেকে এমন অনেক নেতৃত্ব ওঠে এসেছে, যারা বর্তমান সময়ের তথাকথিত নেতা এবং স্বার্থপর ও দুর্নীতিবাজ নেতৃত্বের অন্যতম বিকল্প।

গত তিন দশকে দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ইসলামী ছাত্র মজলিসের কর্মীরা সামর্থ্যরে সর্বোত্তম নজরানা পেশ করেছে। নিজেদের জীবন-যৌবন বিলীন করে দ্বীনের পতাকাকে সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সংগঠনের দায়িত্বশীল থেকে সাধারণ সমর্থক পর্যন্ত দ্বীনের প্রতিটি ব্যাপারে কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কেরামকে নিজেদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এজন্য যখনই কোন খোদাদ্রোহী বা বাতিল মতবাদ মাথাছাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্ঠা করেছে, তখনই শীশাঢালা প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।

১৯৯৪ সালে মুরতাদ লেখিকা তসলিমা নাসরিন বিরোধী দেশব্যাপী আন্দোলনে কিশোরগঞ্জের রাজপথে পুলিশের বুলেটের আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন ছাত্র মজলিস কর্মী শহীদ আরমান। ২০০১ সালে ফতোয়া বিরোধী রায়ের প্রতিবাদে আন্দোলনে শরীক হয়ে শাহাদাতবরণ করেন বি-বাড়িয়ার শহীদ তাজুল ইসলাম ও শহীদ সাইফুল ইসলাম। ২০০২ সালে ঢাকার মালিবাগে মসজিদ রক্ষার আন্দোলনে প্রাণ হারান হাফেজ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া। ২০১৩ সালে নাস্তিক-মুরতাদ বøগারদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনে অংশ নিয়ে শাহাদাতের অমীয় সূধা পান করেন ছাত্র মজলিস কর্মী মানিকগঞ্জের হাফেজ শাহ আলম। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ২৮ এপ্রিল দীর্ঘ কারাভোগে কিডনি ড্যামেজ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ইসলামী ছাত্র মজলিসের ঢাকা জেলা সভাপতি মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশ ও ইসলাম বিরোধী প্রতিটি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ইসলামী ছাত্র মজলিস সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৯২ সালে ভারতের বাবরী মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদে আয়োজিত লংমার্চে শৃঙ্খলা বিভাগের দায়িত্ব পালন করেছে ইসলামী ছাত্র মজলিস। ১৯৯৪ সালে কুখ্যাত লেখিকা স্বঘোষিত নাস্তিক তসলিমা নাসরিন বিরুধী অন্দোলন, ২০০১ সালে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ প্রতিবাদে আন্দোলন, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস প্রতিরোধে আন্দোলন, ফাযিল-কামিল ও কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতির আন্দোলনসহ ১৩ দফা শিক্ষা দাবি বাস্তবায়নে বিভিন্ন সময়ে নানামুখী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে-ময়দানে সরব ভূমিকা পালন করে আসছে এই সংগঠন।

বন্যা-জলচ্ছাস, অগ্নিকাÐসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনা ও দুর্যোগকালীন সময়ে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, শীত মৌসুমে দরিদ্র শীতার্ত মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ এবং সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের জন্য মসজিদ-মাদরাসা, টিবওয়েল-স্যানিটেশন নির্মাণ, গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ এবং লজিং ও টিউশনির ব্যবস্থা করে দেয়াসহ নানাবিধ ছাত্রকল্যাণমূলক ও সামাজিক তৎপরতায় আত্মনিয়োগ করে ছাত্র সমাজ ও সাধারণ মানুষের ভালোবাসা কুড়িয়েছে এই কাফেলা।

ইসলামী ছাত্র মজলিস তার জনশক্তিদের সুপ্ত প্রতিভা ও মেধা বিকাশের লক্ষ্যে কর্মশালা-শিক্ষাসভায় সাংগঠনিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নিয়মিত ব্যক্তিগত রিপোর্ট সংরক্ষণের প্রতি জোর গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। শিক্ষার্থীদেরকে সমসাময়িক অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে এবং একাডেমিক পড়ালেখার পাশাপাশি নৈতিক চরিত্রের চর্চা ও বিকাশে শাখা পর্যায়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছে। মাদক, উগ্রবাদ এবং তথ্যপ্রযুক্তির লাগামহীন ব্যবহার থেকে জনশক্তিদেরকে নিরাপদ রাখতে একজন দরদী অভিভাবকের ভূমিকা পালন করছে ইসলামী ছাত্র মজলিস।

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস নিছক কোন ছাত্র সংগঠনের নাম নয়। ইসলামী ছাত্র মজলিস সাময়িক কোন জয়-পরাজয়ের হিসাব করে না। কাউকে ক্ষমতা থেকে নামানো কিংবা কাউকে ক্ষমতার মসনদে বসানোর জন্য ছাত্র মজলিস আন্দোলন করে না। এই সংগঠন চায় একটি পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব। এই কাফেলা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। জ্ঞান অর্জন, চরিত্র গঠন ও সমাজ বিপ্লবের দাওয়াত দিয়ে ছাত্র সমাজের মাঝে একটি আমূল পরিবর্তন আনতে চায় ইসলামী ছাত্র মজলিস। ছাত্র মজলিস চায় সমাজে ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইহকালিন কল্যাণ এবং আল্লাহর সন্তোষ ও পরকালিন মুক্তি।

প্রতিষ্ঠা দিবসে মহান আল্লাহর দরবারে কামনা, আল্লাহ যেন এই কাফেলার পথচলাকে আরও গতিশীল ও দুর্বার করে দেন এবং আমাদের সকল প্রচেষ্ঠা তাঁর সন্তুষ্ঠি ও জান্নাতের বিনিময়ে কবুল করেন। আমীন।