সূরা আল হুজরাত ১-৮ : দায়িত্বশীলের প্রতি শিষ্টাচার

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَن تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ

إِنَّ الَّذِينَ يَغُضُّونَ أَصْوَاتَهُمْ عِندَ رَسُولِ اللَّهِ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ امْتَحَنَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ لِلتَّقْوَىٰ ۚ لَهُم مَّغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيمٌ

إِنَّ الَّذِينَ يُنَادُونَكَ مِن وَرَاءِ الْحُجُرَاتِ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ وَلَوْ أَنَّهُمْ صَبَرُوا حَتَّىٰ تَخْرُجَ إِلَيْهِمْ لَكَانَ خَيْرًا لَّهُمْ ۚ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَن تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ

وَاعْلَمُوا أَنَّ فِيكُمْ رَسُولَ اللَّهِ ۚ لَوْ يُطِيعُكُمْ فِي كَثِيرٍ مِّنَ الْأَمْرِ لَعَنِتُّمْ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الْإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ ۚ أُولَٰئِكَ هُمُ الرَّاشِدُونَ
فَضْلًا مِّنَ اللَّهِ وَنِعْمَةً ۚ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
وَإِن طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ۖ فَإِن بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيءَ إِلَىٰ أَمْرِ اللَّهِ ۚ فَإِن فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا ۖ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ

َবঙ্গানুবাদ :
১. মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ ও রাসুলের চেয়ে অগ্রগামী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন।
২. হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের আওয়াজ রাসূলের আওয়াজের চেয়ে উঁচু করো না এবং উচ্চস্বরে নবীর সাথে কথা বলো না যেরূপ তোমরা নিজেরা পরস্পর বলে থাকো। এমন যেন না হয় যে; তোমাদের অজান্তেই তোমাদের সব কাজকর্ম ধ্বংস হয়ে যায়।
৩. যারা আল্লাহর রাসূলের সামনে তাদের কণ্ঠস্বর নিচু রাখে তারাই সে সব লোক আল্লাহ যাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য বাছাই করে নিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।
৪. হে নবী, যারা আপনাকে প্রাচীরের বাইরে থেকে ডাকাডাকি করতে থাকে তাদের অধিকাংশই নির্বোধ।
৫. যদি তারা আপনার বের হয়ে আসা পর্যন্ত ধৈর্য্যধারণ করতো তবে তাদের জন্য মঙ্গলজনক হতো। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
৬. হে ঈমানদারগণ, যদি কোন ফাসেক তোমাদের কাছে কোন খবর নিয়ে আসে তাহলে তা অনুসন্ধান করে দেখ। এমন যেন না হয় যে, না জেনে শুনেই তোমরা কোন গোষ্ঠীর ক্ষতি করে বসবে এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।
৭. ভালো করে জেনে রাখ আল্লাহর রাসূল তোমাদের মাঝে রয়েছেন। তিনি যদি বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তোমাদের কথা মেনে নেন তবে তোমরাই অনেক সমস্যার মধ্যে পড়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের মধ্যে ঈমানের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তা তোমাদের কাছে পছন্দনীয় করে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে কুফরী, পাপাচার ও অবাধ্যতাকে ঘৃনিত করে দিয়েছেন।
৮. আল্লাহর দয়া ও মেহেরবাণীতে এসব লোকই সৎপথের অনুগামী। আল্লাহ জ্ঞানী ও কুশলী।

নামকরণঃ ৪র্থ আয়াতের বাক্য থেকে গৃহীত।

নাযিল হওয়ার সময়কালঃ বিভিন্ন বর্ণনা ও সুরার বিষয়বস্তু থেকে বোঝা যায় এ সুরা বিভিন্ন পরিবেশ ও ক্ষেত্রে নাযিল হওয়া শিষ্টাচারমূলক হুকুম আহকাম ও নির্দেশ সমূহের সমষ্টি। বিষয়বস্তুর সাদ্যৃশ্যের কারণে এগুলোকে এখানে একত্রিত করা হয়েছে।

৪র্থ আয়াত সম্পর্কে ঘটনা –
৯ম হিজরি সনে বনী তামিম গোত্রের এক প্রতিনিধি দল রাসূল (স:) এর নিকট উপস্থিত হয়। তখন মসজিদে নববীতে এই গোত্রের শাসনকর্তা নিয়োগ সম্পর্কিত আলোচনা চলছিল। হযরত আবু বকর রা: রা’কা ইবনে হাকিমের নাম এবং হযরত উমর রা: আকরা ইবনে হাফসের নাম প্রস্তাব করেন। হযরত আবু বকর রা: এবং হযরত উমর রা: এর মধ্যে চলমান এ আলোচনা এক পর্যায়ে কথা কাটাকাটিতে উন্নীত হয়ে উভয়ের কণ্ঠস্বর উঁচু হয়ে যায়। (বুখারী)
আলোচ্য আয়াতসমূহের অবতরণ সম্পর্কে ইমাম কুরতুবীর ভাষ্য অনুযায়ী ৬টি ঘটনা বর্ণিত আছে। সব ঘটনাই নির্ভুল।

৬ষ্ঠ আয়াত সম্পর্কে ঘটনা –
মুসনাদে আহমাদের বরাত দিয়ে ইবনে কাসীর বলেন,
বনী মুস্তালিক গোত্রের সরদার হারেস ইবনে মেরার ইসলাম গ্রহণের পর রাসুল (স:) তাকে যাকাত প্রদানের আদেশ দিলেন। তিনি যাকাত প্রদানে রাজি হলেন এবং তার গোত্রে যারা ইসলাম গ্রহণ করবে তাদের সকলের যাকাত আদায় করে জমা করে রাখবেন। রাসূল (স:) কে একটি নির্দিষ্ট তারিখে যাকাতের অর্থ নেওয়ার জন্য কোন দূত পাঠাতে বললেন। কিন্তু নির্ধারিত তারিখ পার হয়ে যাওয়ার পরও কোন দূতের দেখা না পেয়ে হারেস আশংকা করলেন যে, রাসূল (স:) কোন কারণে তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এ আশংকার কথা তিনি ইসলাম গ্রহণকারী নেতৃস্থানীয় লোকদের কাছে প্রকাশ করে রাসূল (স:) এর সাথে সবাই মিলে দেখা করার ইচ্ছা করলেন। এদিকে রাসূল (স:) নির্ধারিত তারিখে ওলীদ ইবনে উকবাকে যাকাত আদায়ের জন্য প্রেরণ করলেও তিনি পথিমধ্যে ধারণা করেন যে, এই গোত্রের লোকদের সাথে তার পুরাতন শত্রুতা আছে। পাছে তাকে একা পেয়ে হত্যা না করে ফেলে এই ভয়ে তিনি ফিরে আসেন। রাসূল (স:) কে বললেন তারা যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে এবং আমাকে হত্যা করার ইচ্ছা করেছে। রাসূল (স:) রাগান্বিত হয়ে বনী মুস্তালিক গোত্রের বিরুদ্ধে খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বে একদল মুজাহিদ প্রেরণ করলেন। খালিদ সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন যে ওলীদ ইবনে উকবা সেখানে যায়নি বরং রাসুল স. কে এসে মিথ্যা কথা বলেছেন।
কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে – ওলীদ ইবনে উকবা নির্দেশ অনুযায়ী বনু মুস্তালিক গোত্রে পৌঁছেন। গোত্রের লোকেরা অভ্যর্থনা জানানোর উদ্দেশ্যে বস্তি থেকে বের হয়ে আসে। ওলীদ সন্দেহ করেন যে, তারা বোধ হয় পুরাতন শত্রুতার কারণে তাকে হত্যা করতে আসছে। তিনি সেখান থেকে ফিরে এসে এ ধারণা ব্যাক্ত করলে রাসূল (স:) খালিদ ইবনে ওলীদকে ঘটনা পর্যবেক্ষণের নির্দেশ দিলেন। তিনি ফিরে এসে সংবাদ দিলেন যে, তারা ঈমানের উপর অটল রয়েছে এবং যাকাত দিতে প্রস্তুত।
ওলীদ ইবনে উকবা মক্কা বিজয়ের সময় মুসলমান হয়েছিলেন। তাই এটি স্পষ্ট যে এ সুরার বেশীর ভাগ অংশই মাদানী যুগের শেষ পর্যায়ে নাজিলকৃত।

আলোচ্য বিষয়ঃ

  • এ সুরার বিষয়বস্তু হলো মুসলমানদেরকে এমন আদব-কায়দা, শিষ্টাচার ও আচরণ শিক্ষা দেওয়া যা তাদের ঈমানসুলভ স্বভাব-চরিত্র ও ভাবমূর্তির উপযুক্ত ও মানানসই।
  • প্রথম ৫ আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে আদব কায়দা শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
  • এরপর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, প্রতিটি খবরকেই বিশ্বাস করা এবং সে অনুযায়ী তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ঠিক নয়।
  • মুসলমানদের দু’টি দল যদি কোন সময়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রে অন্য মুসলমানদের কর্মনীতি কী হবে তা।
  • মুসলমানদেরকে কিছু খারাপ বিষয় থেকে আত্মরক্ষার নির্দেশ দেয়া হয়েছে-
    • একে অপরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা
    • উপহাস করা
    • উপনাম বা খারাপ নামে ডাকা
    • গোপন বিষয়ে খোঁজাখুজি বা অনুসন্ধান করা প্রভৃতি
  • সবশেষে বলা হয়েছে- ঈমানের মৌখিক দাবী প্রকৃত জিনিস নয় বরং সরল মনে আল্লাহ ও রাসূলকে মানা, কার্যত অনুগত থাকা এবং কুরবানী করা।

১ম আলোচ্য বিষয়ঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চেয়ে অগ্রগামী না হওয়া। এটা ঈমানের প্রাথমিক ও মৌলিক দাবী। অর্থ্যাৎ,

  • কোন ঈমানদার নিজের মতামত ও ধ্যান-ধারণাকে আল্লাহ ও রাসূলের সিদ্ধান্তের চেয়ে অগ্রাধিকার দিতে পারে না এবং মতামত পোষন করতে পারে না।
  • সুরা আহযাবের ৩৬ নং আয়াতে এরূপ নির্দেশ রয়েছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যে বিষয়ে ফয়সালা করে দিয়েছেন সে বিষয়ে আলাদা কোন ফয়সালা করার এখতিয়ার কোন ঈমানদারের জন্য আর অবশিষ্ট থাকে না।
    • এ নির্দেশটি শুধু ব্যক্তিগত নয় বরং মুসলমানদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য (সরকার, বিচারালয়, পার্লামেন্ট)। সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসঃ মুয়ায ইবনে জাবালকে ইয়েমেনের বিচারক করে পাঠানোর সময় নবী (স:) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কিসের ভিত্তিতে ফয়সালা করবে?’ তিনি বললেন- ‘আল্লাহর কিতাব অনুসারে।’ নবী (স:) বললেন যদি কিতাবে না পাওয়া যায়? তিনি জবাব দিলেন, আল্লাহর রাসূলের সুন্নাতের সাহায্য নেব। নবী (স:) বললেন, যদি সেখানে না পাও? তিনি জবাব দিলেন, তাহলে আমি নিজেই ইজতেহাদ করবো।’
    • তাই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাবই সর্বপ্রথম উৎস এবং তারপরই হাদীসের স্থান। এরপর ইজমা ও কিয়াস। এক্ষেত্রে নিজেদের একচ্ছত্র মতামতকে প্রাধান্য দিলে বোঝাপড়া হবে আল্লাহর সাথে।

২য় আলোচ্য বিষয়ঃ যারা রাসূল (স:) এর মজলিশে যাতায়াত করতো তাদেরকে এ আদব শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য- তাঁর সাথে কথা বলার সময় যেন তাঁর মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রাখা হয়।

  • এক্ষেত্রে যখনই নবী (স:) এর আলোচনা করা হয় এবং তাঁর হাদীস বর্ণনা করা হয় সর্বাবস্থায় তাঁর প্রতি শিষ্টতা বজায় রাখা দরকার।
  • নিজের চাইতে উচ্চ মর্যাদার লোকদের সাথে কথা বলার শিষ্টতা এখানে শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
  • ইসলামে রাসূলের (স:) ব্যক্তিসত্ত্বার মর্যাদা এ আয়াত থেকে বুঝা যায়। রাসূলের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে সামান্য শিথিলতায় সারা জীবনের সঞ্চিত পুঁজি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। নবীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা না করা মূলত আল্লাহর প্রতি করা না করার পর্যায়ভুক্ত।

৩য় আলোচ্য বিষয়ঃ অর্থ্যাৎ যে হৃদয়ে রাসূলের (স:) মর্যাদা নেই সে হৃদয়ে তাকওয়া থাকতে পারে না। যারা বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তারা রাসূলের প্রতি তাদের পক্ষ থেকে যথাযথ মর্যাদা প্রদর্শন করে।

৪র্থ আলোচ্য বিষয়ঃ বেদুইন আরবের সে পরিবেশে যেখানে সাধারণভাবে মানুষ কোন প্রকার শিষ্টাচারের শিক্ষা পায়নি তাদের অনেকেই সময়ে অসময়ে রাসূলের (স:) সাথে সাক্ষাতের জন্য হাজির হতো। তাঁর হুজরার চারদিকে ঘুরে ঘুরে বাইরে থেকেই তাঁকে ডাকতো। স্বভাবগত কারণেই রাসূল (স:) এসব সহ্য করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলেন। অর্থ্যাৎ চিৎকার না করে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করলে রাসূল (স:) নিজেই এসে তাদের সাথে সাক্ষাত করতেন। এ আয়াতে এসব ভুলের পুনরাবৃত্তি না করার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে।

৫ম আলোচ্য বিষয়ঃ কোন সংবাদ শুনার সাথে সাথে যাচাই না করে বিশ্বাস করতে নিষেধ করা হয়েছে। অধিকাংশ মুফাস্সিরের মতে এটি ওলীদ ইবনে ওকবা ইবনে আবা মুআ’ইত সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। বনু মুসতালিক গোত্র সম্পর্কে ওয়ালীদ ইবনে উকবার খবরের ভিত্তিতে নবী (স:) তাদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। কিন্তু কিছু সাহাবী তৎক্ষনাৎ তাদের বিরুদ্ধে আক্রমন করার জন্য নবী (সা:) কে পীড়াপীড়ি করছিল। এ প্রেক্ষিতে এই আয়াত।

হযরত উম্মে সালামা বর্ণিত হাদীসে পুরো ঘটনাটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইসলামের নাজুক পরিস্থিতিতে যখন একটি ভিত্তিহীন সংবাদকে কেন্দ্র করে এত বড় ভুল সংঘটিত হতে যাচ্ছিল সে মুহুর্তে আল্লাহ এ মৌলিক নির্দেশ দিলেন যে, যখন এমন কোন খবর পাওয়া যাবে যার ভিত্তিতে বড় রকমের কোন ঘটনা সংঘটিত হতে পারে তখন তা বিশ্বাস করার পূর্বে বার্তাবাহক কেমন ব্যক্তি তা যাচাই করতে হবে।

  • যার বাহ্যিক অবস্থা দেখেই প্রতীয়মান হয় যে, বার্তাবাহক নির্ভরযোগ্য নয় (ফাসেক) তবে প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী কাজ করার পূর্বে তা যাচাই করা দরকার।
  • যার চরিত্র ও কর্ম নির্ভরযোগ্য নয় এমন কোন সংবাদদাতার সংবাদের উপর ভিত্তি করে কোন, ব্যক্তি, জাতি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইসলামী সরকারের জন্য বৈধ নয়।
  • হাদীস শাস্ত্রবিদগণ এ প্রেক্ষিতে ‘জারহ ও তা’দীল’ এর নীতি উদ্ভাবন করেছেন-যাদের মাধ্যমে নবী (সা:) এর হাদীস পরবর্তী বংশধরদের নিকট পৌঁছেছিল তাদের অবস্থা যাচাই করা যায়।
  • তাছাড়া সাক্ষ্য আইনের ক্ষেত্রে নীতি হলো এমন কোন ব্যাপারে ফাসেক ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না যা দ্বারা শরীয়তের কোন নির্দেশ প্রমাণিত হয় কিংবা কোন মানুষের উপর কোন অধিকার বর্তায়।
  • তবে সাধারণ পার্থিব ব্যাপারে প্রতিটি খবর অনুসন্ধান এবং সংবাদদাতার নির্ভরযোগ্যতা জরুরী নয়। কারণ, আয়াতে গুরুত্বপূর্ণ খবর বলা হয়েছে।

৬ষ্ঠ আলোচ্য বিষয়ঃ অর্থ্যাৎ কতিপয় লোক তাদের অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত জানালেও মুসলমানদের গোটা জামায়াত ভুল করেনি। মুমিনদের সঠিক পথের উপর কায়েম থাকার কারণ হচ্ছে আল্লাহ তার দয়া ও মেহেরবানীতে ঈমানী আচরণকে তাদের জন্য প্রিয় ও হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন এবং নাফরমানী আচরণকে ঘৃনিত করে দিয়েছেন।
আয়াতের দু’টি অংশে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছেঃ

যারা বনু মুসতালিকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য পীড়াপীড়া করছিল তাদের কথা বলা হয়েছে।
কথা বলা হয়েছে যারা নিজেদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করেনি। বরং ঈমানের দাবীর উপর অটল ছিলেন। তবে তারা ঈমানের প্রতি অটল ছিল না একথা বলা হয়নি, বরং শিথিলতার কথা বলা হয়েছে। তাই আল্লাহ প্রথমে এর ভুল ও কুফল তুলে ধরেছেন।

৭ম আলোচ্য বিষয়ঃ আল্লাহর অনুগ্রহ ও মেহেরবানী কোন ভাগ বাটোয়ারার বিষয় নয়। আল্লাহ তা যাকে ইচ্ছা তাকে দান করেন।

উক্ত আয়াতসমূহের শিক্ষাঃ
১) ধর্মীয় আলেমদের ক্ষেত্রে এ বিধান কার্যকর, কারণ তারা পয়গম্বরদের উত্তরাধিকারী। একদিন রাসূল (স:) আবু দারদা (রা:)কে আবু বকর (রা:) এর অগ্রে চলতে দেখে সতর্ক করে বললেন, তুমি কি এমন ব্যক্তির অগ্রে চল যিনি ইহকাল ও পরকালে তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ? তিনি আরও বললেন, দুনিয়াতে এমন কোন ব্যক্তির উপর সুর্যোদয় ও সুর্যাস্ত হয়নি যে পয়গম্বরদের পর হযরত আবু বকর থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ। (রুহুল বয়ান)

২) উচ্চ স্বরে কথা না বলাঃ
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَن تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ এ আয়াত নাযিলের পর –
হযরত আবুবকর (রা:) আরজ করলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ আল্লাহর কসম! এখন মৃত্যু পর্যন্ত আপনার সাথে কানাকানির অনুরূপে কথা বলব। (বায়হাকী)
হযরত উমর (রা:) এরপর থেকে এত আস্তে কথা বলতেন যে, প্রায়ই পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হতো। (সেহাহ)
হযরত সাবেত ইবনে কায়সের কণ্ঠস্বর স্বভাবগতভাবেই উঁচু ছিল। এ আয়াত নাযিলের পর তিনি ভয়ে সংযত হলেন এবং কণ্ঠস্বর নিচু করলেন। (দুররে মনসুর)
কাযী আবু বকর ইবনে আরাবী (রহ:) বলেন রাসূল (সা:) এর সম্মান ও আদব তার ওফাতের পরও জীবদ্দশার ন্যায় ওয়াজিব। কোন কোন আলেম বলেন, তাঁর কবরের সামনে উচ্চস্বরে কথা বলাও আদবের খেলাফ। যে মজলিসে হাদীস পাঠ হয় সেখানে হট্টগোল করা বে-আদবী।
– কণ্ঠস্বর উঁচু করলে আমল বিনষ্ট হয় যায়। কিন্তু আমরা জানি আমল নষ্ট হয় কুফরীর কারণে। সুতরাং এখানে কুফরীর শাস্তি কিভাবে হতে পারে ?
মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ:) তার বায়ানুল কুরআনে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন – রাসূলের কণ্ঠ থেকে নিজেদের কণ্ঠস্বর উঁচু হলে আমল বিনষ্ট হওয়ার আশংকা রয়েছে কারণ রাসূল স. কষ্ট পাবেন।

৩) হুজরার বাইরে থেকে ডাকাডাকি করাঃ
ইমাম বগাভী (রহ:) কাতাদাহ (রহ:) এর রেওয়ায়েতক্রমে বর্ণনা করেন যে, বনু তামীমের লোকগণ দুপুরের সময়ে মদীনায় উপস্থিত হয়েছিল। তখন রাসূল (সা:) কোন এক হুজরায় বিশ্রামরত ছিলেন। তারা ছিল বেদুঈন এবং সামাজিকতার রীতিনীতি থেকে অজ্ঞ। তারা হুজরার বাইরে থেকেই ডাকাডাকি শুরু করল : “হে মুহাম্মদ, আমাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসুন” (মাযহারী)


সাহাবী ও তাবেয়ীগণ তাদের আলেমদের সাথেও অনুরূপ ব্যবহার করতেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত আছে- আমি যখন কোন আলেম সাহাবীর কাছে থেকে কোন হাদীস লাভ করতে চাইতাম তখন তার গৃহে পৌঁছে ডাকাডাকি বা দরজার কড়া নাড়া থেকে বিরত থাকতাম এবং দরজার বাইরে বসে অপেক্ষা করতাম। তিনি যখন নিজেই বাইরে আসতেন তখন আমি তার নিকট হাদীস জিজ্ঞেস করতাম। তিনি দেখে বলতেন, হে রাসূলুল্লাহর চাচাত ভাই, আমাকে আপনি কড়া নেড়ে সংবাদ দিলেন না কেন? উত্তরে বলতাম- আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে, তাদের বাইরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।

হযরত আবু ওবায়দা (রহ:) বলেন আমি কোনদিন কোন আলেমের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়া দেইনি বরং অপেক্ষা করেছি যে, তিনি নিজেই বাইরে আসলে সাক্ষাত করব। (রুহুল মা’আনী)