১৭৫৭ সালের পলাশীর আম্রকানন: একটি বেদনাবিধুর

১৯৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার আকাশে নেমে এসেছিল বেইমানি,বিশ্বাসঘাতকতা আর নির্মমতার কালো ছোবল। ঘরের শত্র বিভিষন বলে বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে। নবাব সিরাজ উদ দৌলার ক্ষেত্রে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। মোগল সম্রাটদের নিকট থেকে অবাধ সুযোগ সুবিধা পাবার পরও বাংলার স্বাধীন নবাবগণ দক্ষতার সাথে দৃঢ় হস্তে ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সিরাজ উদ দৌলা বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হবার পরই ঘরের শত্রুরা ব্যাপকভাবে তৎপর হয়ে ওঠে।

নবাবের খালা ঘসেটি বেগম পূর্ণিয়ার ফৌজদার শওকত জঙ্গকে মসনদে বসানোর জন্যে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। মীর জাফর আলী খান সে ষড়যন্ত্রে একাত্মতা ঘোষণা করে। রাজবল্লব, উমিচাঁদ, নবকুমার, জগৎশেঠ, রায়দূর্লভ, মানিকচাঁদ, কৃষ্ণচন্দ্র প্রমূখ কেউবা সরাসরি প্রকাশ্যে আর কেউবা বাহ্যত নবাবের প্রতি আনুগত্য ও মিত্রতা রেখে গোপনভাবে ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্র করে নবাবকে ক্ষমতার মসনদ থেকে উৎখাত করার মিশন নিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে মেতে ওঠে। ইংরেজরা দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের একটি সুযোগই অনুসন্ধান করছিল।

বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুমান করে ইংরেজ কোম্পানি নিজেদের ভবিষ্যত প্রস্তুতি হিসেবে ১৭৫৬ সালের মাঝামাঝি নবাবের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ফোর্ট ইউলিয়ামকে সামরিক সাজে সজ্জিত করতে শুরু করে।

নবাব সিরাজ উদ দৌলা সামরিক প্রস্তুতির বিষয়ে সতর্ক করে দূর্গদেয়াল ভেঙ্গে পরিখা বন্ধ করা এবং রাজকীয় কোষাগার আত্মসাত করে কাশিমবাজার কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটসের নিকট আশ্রিত কৃষ্ণবল্লভকে ফেরত দেয়ার জন্য যথাক্রমে ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল এবং গভর্নর ড্রেককে নির্দেশ দেন। কোম্পানি এ নির্দেশকে অস্বীকার পূর্বক নবাবের প্রেরিত প্রতিনিধি নারায়ন সিংহ ও খাজা ওয়াহিদকে অপমান করে কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দেয়।

নবাব এ প্রতিশোধ কল্পে ঐ সালের ১৩ জুন কোলকাতা অবরুদ্ধ করে ২০ জুনের মধ্য

কোলকাতাকে ইংরেজমুক্ত করেন।

কাশিমবাজার এবং কোলকাতার পতনের খবর মাদ্রাজ ও ইংল্যান্ডে পৌঁছলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১৭৫৭ সালের ২৩ এপ্রিল ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল মুর্শিদাবাদে অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ মর্মে তারা তথাকথিত নবাবঘরানার প্রধান ব্যক্তিদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সে সূত্রেই নবাব দরবারের ইংরেজ প্রতিনিধি উইলিয়াম ওয়াটস ও লিউক স্ক্রেফটনের মাধ্যমে ১৭৫৭ সালের ৪ জুন মুর্শিদাবাদের এক গোপন কক্ষে মীর জাফর ইংরেজদের সাথে একটি গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।

চুক্তিতে উল্লেখ করা হয় যে, নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করে মীর জাফরকে নবাব মনোনীত করা হবে; কোলকাতার ক্ষতিপূরণ বাবদ মীর জাফর ইংরেজ কোম্পানিকে ১০০ লক্ষ, ইউরোপীয়দেরকে ৫০ লক্ষ, হিন্দুদেরকে ২০ লক্ষ এবং আর্মেনীয়দেরকে ৭ লক্ষ টাকা দেবেন। জগৎশেঠ, ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লব, সেনাপতি রায়দূর্লভ, নন্দকুমার, শিখ ব্যবসায়ী উমিচাঁদ প্রমুখ ছিলো ষড়যন্ত্রের মধ্যমনি।

চুক্তির কার্যকারিতা লাভ করার জন্য ইংরেজ কোম্পানি বিভিন্ন অজুহাতে যুদ্ধ অনিবার্য করে তোলে। নবাব সিরাজ মীর জাফর সম্পর্কে সন্দিহান হলেও মীর জাফর দেশের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা করার নিমিত্তে পবিত্র কুরআন ছুঁয়ে শপথ করে। নবাব সরল বিশ্বাসে সে শপথের বিশ্বস্ততায় অবশেষে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন মীর জাফরকে সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের মোকাবেলায় প্রেরণ করেন। সেই হীন নীচমন বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর স্বাধীনতার উজ্জ্বল সূর্যকে ধুরন্দর ক্লাইভ ও ওয়াট্সদের হাতে সমর্পন করে নির্লজ্জভাবে।

হতভাগ্য নবাব বিহার সীমান্তে রক্ষিত তাঁর বিশ্বস্ত বাহিনীর সাহায্যে শেষ চেষ্টা চালানোর প্রয়াসে ব্যর্থ হলে পালিয়ে যাবার সময় পথে ধৃত হয়ে মুর্শিদাবাদেই ফিরে আসেন। অবশেষে তাঁরই পিতামাতার আদরে লালিত বিশ্বাস ঘাতক মোহাম্মাদী বেগের হাতে তিনি শহীদ হন। শহীদ হন নবাব আর অস্তমিত হয় স্বাধীনতার লাল সূর্য।

পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলায় প্রকারান্তরে ইংরেজদের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।নবাব (?) মীর জাফর ইংরেজের ক্রীড়নকে পরিণত হন। বক্সারের যুদ্ধের পর ১৭৬৫ সালের দেওয়ানী লাভের মধ্য দিয়ে ইংরেজদের পুরোপুরি সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়ে বাংলায় ব্যাপক লুন্ঠণ ও শোষণ চলে।

১৭৫৭-১৭৮০ সালের মধ্যে মাত্র ২৩ বছরে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে চালান হয়েছে ৩ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ড বা ৬০ কোটি টাকা। ১৯০০ সালে এর সমমূল্য দাড়ায় ৩০০ কোটি টাকা। তাহলে ২০০৮ সালে এর মূল্য কত হাজার কোটি টাকা হবে তা হিসেব সাপেক্ষ বিষয়।

এছাড়া পলাশীতে বাংলার সূর্য অস্তমিত হবার পর পরই ঘোর আঁধারের সুযোগে মীর জাফর নবাবের হীরাঝিল প্রাসাদ লন্ঠণ করেন। হীরাঝিলের প্রকাশ্য ধনভাণ্ডারে সঞ্চিতসম্পদের মধ্যে ছিল ৩২ লাখ স্বর্ণমুদ্রা, দুই সিন্ধুক অমুদ্রিত স্বর্ণপিণ্ড, ৪ বাক্স হীরা জহরত, ২ বাক্স চুনি-পান্না প্রভৃতি মূল্যবান পাথরসহ এবং ১ কোটি ৭৬ লাখ রৌপ্য মুদ্রা ও ৮ কোটি টাকা।

এভাবে নগদ অর্থ লুন্ঠণের পাশাপাশি রাজস্ব বিভাগ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে আনা হয় এবং অধিক মাত্রায় রাজস্ব আদায়ের জন্য কৃষক সম্প্রদায়ের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। অন্যান্য বিদেশী বণিকদের বিতাড়িত করে ইংরেজরা নিজেদের ইচ্ছেমত মূল্যে পণ্য ক্রয় বিক্রয় শুরু করে, এমনকি কৃষকদের পণ্য উৎপাদন মূল্যের চেয়ে পণ্যমূল্য হ্রাস পায়।

ফলে লবন শিল্প, তাত শিল্প, চিনি শিল্প ও রেশম শিল্পসহ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জীবন চলার পথ বন্ধ হয়ে আসে। অন্যদিকে বাংলার মুসলমান অভিজাত শ্রেণীকে সামরিক বাহিনী, রাজস্ব আদায় ও বিচার বিভাগের চাকুরী থেকে পদচ্যুত করার কারণে তারাও ক্রমাগত দারিদ্রের কোটায় নেমে পড়ে।

শিক্ষা-সংস্কৃতি সব কিছুতেই এই অঞ্চলের মানুষ হয়ে পড়ে পশ্চাৎপদ। ইংরেজদের খাজনা, নির্যাতন এবং তৎকালীন জমিদারদের গুদামজাতকরণ নীতির পরিণত পরিণতি হিসেবে ১৭৭৬ সালে পরিকল্পিত দূর্ভিক্ষের কবলে পড়ে বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষ অত্যন্ত নির্মম ভাবে মারা যায়।

এ দুঃখজনক প্রেক্ষাপটে পলাশী আমাদের স্বাধীনতার শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করে দিচ্ছে, স্বরূপ উদঘাটন করে দিচ্ছে বিশ্বাস ঘাতকদের। তাই বংঙ্গবন্ধু, সম্রাট জাহাঙ্গীর, সম্রাট শাহজাহান, কিংবা নবাব সিরাজ উদ্ দৌলার মত উদারতা ও সরলতা দেখানো যাবে না।

আজো আমরা দেখি সাম্রাজ্যবাদীরা বিভিন্ন ইস্যুতে পরামর্শ দেবার নাম করে এই বাংলাদেশের ভূমিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

তারা বিভিন্ন ব্যক্তি মডেল,সংগঠন,এনজিও,তারকা ইমেজকে কাজে লাগিয়ে নানান ভাবে প্রভাবিত করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে যাচ্ছে।

বাংলার মাটিতে এই রকম বিশ্বাসঘাতক,বেইমান, মীর জাফর অনেক আছে। এদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে এই প্রজন্মের সকলকে। কারণ: পলাশীর মত ঘটনা আর ঘটবে না এমন নিশ্চয়তা এক মূহুর্তের জন্যেও দেয়া যায় না।

লেখক- কে এম ইমরান হোসাইন

সভাপতি, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ