ইসলামের দৃষ্টিতে শিষ্টাচার ও ভদ্রতা

আবদুল হাফিজ খসরু:

ইসলাম হচ্ছে পরিপূর্ণ এক জীবন বিধান। মানবজীবনের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় এমন কোনো সমস্যা নেই যা ইসলাম সমাধান দেয় নাই। ব্যাষ্টিক জীবনের ছোটখাট ভুলভ্রান্তি থেকে শুরু করে বড় বড় ভুলগুলোকেও ইসলাম সুন্দরভাবে সংশোধনের পদ্ধতি তৈরি করে রেখেছে। মূলত মানুষের ছোটখাট কিংবা দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার মত ভুল ত্রুটি থেকেই ধীরে ধীরে বড় ধরণের ভুল, অন্যায় কিংবা ভয়াবহ বিশৃঙ্খলার জন্ম নেয়। পারস্পরিক লেনদেন, কথাবার্তা ও সম্পর্কের মধ্যে যে গুণাবলীটি অনুপস্থিত থাকলে সামগ্রীক মুয়ামালা-মুয়াশারাতের ক্ষেত্রে বিপর্যয় ঘটে তা হলো শিষ্টাচার ও ভদ্রতা। যদিও শিষ্টাচার ও ভদ্রতা বাহ্যিক সৌজন্যতাবোধের পরিচায়ক তথাপি সেখানে আন্তরিকতার মিশ্রণ ঘটানো হলে তা ইবাদতে পরিণত হয়ে যায়। আলোচ্য প্রবন্ধে ইসলামের নির্দেশনার আলোকে শিষ্টাচারের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা আলোচনা করা হলো।

আভিধানিক অর্থ : اَلْاٰدَابُ শব্দটি বহুবচন, এক বচনে اَلْاَدَبُ। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- শিষ্টাচার, ভদ্রতা, লৌকিকতা।

পারিভাষিক অর্থ : আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহ.) বলেন- “আদব বা শিষ্টাচার হচ্ছে উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুসরণ করা।”

মিরকাত গ্রন্থাকার উল্লেখ করেন- “কথায় ও কাজে এমন আচরণ প্রকাশ করা, যার দ্বারা প্রশংসা লাভ করা যায়।”

আবার কারো মতে- “বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং ছোটদের প্রতি ¯েœহ ও মমতা বিতরণ করাকেই আদব বলে।”

সারকথা, আদব এমন কতগুলো উত্তম ও প্রশংসনীয় গুণ এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়, যেগুলোর মাধ্যমে একজন মানুষ আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে।

প্রবন্ধে চার ধরণের শিষ্টাচার সম্বন্ধে আলোচনা করা হবে। ১। কথাবার্তায় শিষ্টাচার ২। চলাফেরায় শিষ্টাচার ৩। বৈঠকী শিষ্টাচার এবং ৪। আচরণগত শিষ্টাচার।

পারস্পরিক কথাবার্তায় শিষ্টাচার
০১. কারো গৃহে প্রবেশের শিষ্টাচার : কোনো আত্মীয়ের গৃহে বা অপরিচিত কারো গৃহে প্রবেশের সময় প্রত্যেক মানুষকে অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকতে নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّىٰ تَسْتَأْنِسُوا وَتُسَلِّمُوا عَلَىٰ أَهْلِهَا ۚ ذَ‌ٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ

অর্থাৎ “হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্য গৃহে প্রবেশ করো না, যে পর্যন্ত আলাপ পরিচয় না করো এবং গৃহবাসীকে সালাম না করো।” (সূরা-আন্ নূর : আয়াত ২৭)

০২. সাক্ষাতের শুরুতে সালাম ও মুসাফাহা করা : সালাম হলো- সাদর সম্ভাষণ। সুতরাং সাক্ষাতের সাথে সাথেই সালাম বা দোয়া বিনিময় যুক্তিসংগত। রাসূল (স.) ইরশাদ করেন-


اَلسَّلاَمُ قَبْلَ الْكَلاَمِ

অর্থ্যাৎ “কথাবার্তা বলার পূর্বেই সালাম দিবে।” (তিরমিযী)

০৩. নম্রভাবে কথা বলা : প্রত্যেক জিনিসের সৌন্দর্য্য ও বৈশিষ্ট্য তার কোমলতা ও নম্রতার মধ্যেই নিহিত থাকে। পক্ষান্তরে নির্দয়ী ও কঠোর আচরণ সমাজে নিন্দনীয় ও বিকৃত। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কথাবার্তায় মানুষের স্বভাব কেমন হবে সে সম্পর্কে বলছেন-

فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَّيِّنًا

অর্থাৎ “তোমরা তার সাথে নম্রভাবে কথা বলো।” (সূরা-ত্বোয়াহা : আয়াত ৪৪)
বস্তুত যার অন্তরে কোমলতা, নম্রতা বা দয়ার্দ্রতা নেই, তার কাছ হতে কল্যাণকর কোনো কিছুই আশা করা যায় না। নম্র স্বভাবই যাবতীয় কল্যাণের উৎস। তা কথার শ্রীবৃদ্ধির কারণ। রাসূল (স.) ইরশাদ করেন- مَنْ يُّحْرَمُ الرِّفْقُ يُحْرَمُ الْخَيْرَ
অর্থাৎ “যাকে কোমলতা হতে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাকে যেনো যাবতীয় কল্যাণ এবং পুণ্যতা হতে বঞ্চিত করা হলো।” (মুসলিম)
কাজেই কথাবার্তায় নম্রতা, কোমলতা অর্জন করে কঠোরতা ও রূক্ষতা পরিত্যাগ করা ইসলামি শিষ্টাচার।

০৪. সত্য ও উত্তম কথা বলা : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করছেন- وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا

অর্থাৎ “মানুষকে সৎ কথাবার্তা বলবে।” (সূরা-আল বাকারা : আয়াত ৮৩)
আয়াতে এমন কথাকে বুঝানো হয়েছে যা সৌন্দর্য্যমণ্ডিত, অশ্লীল নয়। যখন মানুষের সাথে কথা বলবে নম্রভাবে, হাসিমুখে ও খোলামনে ভালো ভালো কথাগুলো বলবে, সে যে ধরণের মানুষই হোক। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো বলেন-

وَقُل لِّعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ

অর্থাৎ “আমার বান্দাদেরকে বলে দিন তারা যেনো যা উত্তম এমন কথাই বলে।” (সুরা-বনি ঈসরাইল : আয়াত ৫৩)
অর্থাৎ পারস্পরিক মতানৈক্যের সময়ও যাতে অশ্লীল, কটু কথা অথবা কঠোর ভাষা প্রয়োগ না করা হয়। যখন এরকম পরিস্থিতির স্বীকার হয় তখনও যেনো উত্তম এবং সুন্দর কথাগুলো বলে।

০৫. গীবত বা চোগলখুরী না করা : কারো অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে কষ্টকর কথাবার্তা বলা, যদিও তা সত্য কথা হয়, তাই গীবতের অন্তর্ভুক্ত। কারো পেছনে দোষচর্চা এতো খারাপ অপরাধ যে, নিন্দাকারী কারো পক্ষ থেকে কোনো বাধা পায় না বলে আরো বড় বড় গুনাহের দিকে ধাবিত হওয়া তার জন্যে সহজ হয়ে যায়। তাই শরীয়তে গীবত চর্চা এবং চোগলখুরী কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا

“তোমাদের কেউ যেনো কারো পশ্চাতে নিন্দা না করে।” (সূরা-আল হুজুরাত : আয়াত ১২)
অন্যত্র আল্লাহ পাক ইরশাদ করছেন-

وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ

“প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর দুর্ভোগ। (সূরা-আল হুমাযাহ : আয়াত ১)
সাধারণ মুসলমানের জন্যে অপরিহার্য্য করা হয়েছে যে, কেউ গীবত শুনলে তার অনুপস্থিত ভাইয়ের পক্ষ থেকে সাধ্যানুযায়ী প্রতিরোধ করা। প্রতিরোধের শক্তি না থাকলে কমপক্ষে তা শ্রবণ থেকে বিরত থাকা।

০৬. কথা সংক্ষেপ করা : সহজ সরল ভাষায় অল্প কথায় বক্তব্য পেশ করা উচিত। কথাকে দীর্ঘায়িত করলে একদিকে শ্রোতাদের মনের মধ্যে চাঞ্চল্য ও বিরক্তিরভাব আসতে পারে এবং বক্তার কথার মধ্যেও অবাঞ্চিত, নিত্যপ্রয়োজনীয় কথাও ঢুকতে পারে।

لَقَدْ رَأَيْتُ اَوْ اُمِرْتُ اَنْ تَجَوَّزَ فِىْ الْقَوْلِ فَاِنَّ الْجَوَازَ هُوَ خَيْرٌ

“আমি দেখেছি অথবা আমাকে আদেশ করা হয়েছে যে, যেনো আমি বক্তব্য সংক্ষেপ করি। কেননা, সংক্ষেপ করাই উত্তম।” (আবু দাউদ)
বলা হয় যে, “যার কথা যতো বেশী হয়, তার কথা ততো বেশী মিথ্যা হয়।” প্রয়োজন মোতাবেক কথাকে সংক্ষেপ বা বর্ধিত করার নির্দেশ। শুধু ভাষার প্যাঁচ খাঁটিয়ে বক্তাকে দীর্ঘায়িত করা ইসলামি শিষ্টাচার বর্জিত।

০৭. কথায় গালি না দেওয়া ও ভর্ৎসনা না করা : মানুষের দোষত্রুটি অন্বেষণ করা। বেশী বেশী লানত ও অভিশম্পাত করা। অশ্লীল গালমন্দ করা একজন ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। এগুলো ইসলামি শিষ্টাচার বহির্ভূত। রাসূল (স.) বলেন-
“একজন পূর্ণাঙ্গ মুমিন তিরষ্কার ও অভিসম্পাতকারী হতে পারে না। আর অশ্লীল গালমন্দকারীও হতে পারে না।” (তিরমিযী ও বায়হাকী)

০৮. অতিরিক্ত কারো প্রশংসা না করা : কেউ ভালো কিছু করলে, সে তার প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। তাই বলে, তাকে খুশী করার জন্যে বা অন্য কোনো সৎ উদ্দেশ্যেই হোক, অতিরঞ্জিত প্রশংসা করা যাবে না। কারণ ঐ ব্যক্তি হয়তো ততটুকু প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য নয় যতটুকু বাড়িয়ে করা হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে সে যদি ফাসিক হয়। তাহলে তা স্পষ্ট নিষিদ্ধ। রাসূল (স.) বলেন-

اِذَا مُدِحَ الْفاَسِقُ غَضِبَ الرَّبُّ تَعَالٰى وَاَهْتَزَّ لَهُ الْعَرْشُ


“যখন কোনো পাপী লোকের প্রশংসা করা হয়। আল্লাহ তায়ালা ক্রুদ্ধ হন এবং তার প্রশংসার কারণে আল্লাহ তায়ালার আরশ কেঁপে উঠে।” (বায়হাকী)

০৯. অনর্থক কথা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা : অনর্থক কথা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা; কিংবা কথায় অতিরঞ্জিত করা ইসলামি আচরণ হতে পারে না। কারণ প্রিয়নবী (স.) বলেন-

هَلَكَ الْمَتَنَطِّعُوْنَ قَالَهَا تَلاَتًا

“কথায় অতিরঞ্জনকারীরা ধ্বংস হয়েছে।” তিনি এ বাক্যটি তিনবার বলেছেন। (মুসলিম)
অনর্থক কথা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে অনেক সময় ঝগড়া পর্যন্ত লেগে যায়। এখান থেকে অন্যান্য বিশৃঙ্খলাও শুরু হয়ে যায়। তাই এটি ইসলামি আচার বহির্ভূত।

১০. মিথ্যা না বলা : রাসূল (স.) বলেন-

كَبُرَتْ خِيَانَةً اَنْ تُحَدِّثَ اَخَاكَ حَدِيْثً هُوَ لَكَ بِهِ مُصَدِّقٌ وَاَنْتَ بِهِ كَاذِبٌ

“সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা হলো এই যে, তুমি তোমার কোনো মুসলমান ভাইকে কোনো কথা বললে, আর সে ওটাকে সত্য বলে জানলো। অথচ প্রকৃতপক্ষে তুমি তার সাথে মিথ্যা বলেছ।” (আবু দাউদ)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি তোমার প্রতি আস্থা রাখে এবং তোমার যেকোনো পরামর্শকে সে বিশ্বাস করে, তার কাছে এমন কোনো কথা বলা বা পরামর্শ দেয়া জায়েয হবে না যা তুমি সত্য মনে করো না। সেটা হবে প্রকাশ্য প্রতারণা ও খেয়ানত।

১১. নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে কৌতুক করা : ইসলামি শিষ্টাচারে কৌতুক করারও অধিকার দিয়েছে, তবে তা হতে হবে শরীয়তের সীমার মধ্যে থেকে। এমন ধরণের কৌতুক বলার অনুমোদন আছে, যা শুনলে কারো স্থায়ী রাগ হওয়ার আশংকা নেই এবং কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা না হয়। রাসুলুল্লাহ স. বাস্তব শিক্ষনীয় বিষয়ে কৌতুক করতেন। একদিন তিনি এক বৃদ্ধা মহিলাকে বললেন- “কোনো বৃদ্ধা বেহেশতে যাবে না।” বৃদ্ধা আরজ করলো, “কি কারণে বৃদ্ধারা বেহেশতে যেতে পারবে না? অথচ তারাতো রীতিমতো কুরআন তেলাওয়াত করে।” তখন রসূল (স.) তাকে বললেন, তুমি কি কুরআনের এই আয়াত পাঠ করনি? اِنَّا اَنْشَأْنٰهُنَّ اِنْشَاءَ . فَجَعَلْنٰهُنَّ اَبْكَارًا
“আমি মহিলাদেরকে দ্বিতীয়বার পয়দা করবো, তখন তাদেরকে কুমারী বানাবো।” (রাযীন, শরহে সুন্নাহ মাসাবীহ্র উদ্ধৃতিতে বর্ণিত)

১২. মুচকি হাসা : ইসলামি শিষ্টাচারের আরেক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সর্বদা হাসিমুখে থাকা। রাসূল (স.) -এর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো যে, তিনি সর্বদাই হাসিমুখে থাকতেন। কারো কোনো কথা বা কাজে অসন্তুষ্ট হলে সেটার চিহ্ন তার চেহারা মোবারকে ফুটে উঠতো। হযরত জারীর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন “যখন হতে আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি, রসূল (স.) আমাকে কোনো অবস্থাতেই তার কাছে আসতে নিষেধ করেননি। যখনই তিনি আমাকে দেখতেন মুচকি হাসতেন।” (বুখারি ও মুসলিম)

চলাফেরায় শিষ্টাচার
০১. নম্রভাবে চলাফেরা করা : মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করছেন,

وَعِبَادُ الرَّحْمَـٰنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا

“রহমান এর বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে।” (সূরা-আল ফুরকান : আয়াত ৬৩)
অর্থাৎ, গর্বভরে না চলা, অহংকারীর ন্যায় পা না ফেলা। আবার খুব ধীর গতিতেও না চলা। কারণ হাদিসে এসেছে, “চলার সময় রাসুলের (স.) চলার পথ যেনো তাঁর জন্যে কুঞ্চিত হতো। (ইবনে কাসীর)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো ইরশাদ করেন- وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ
“নিজ চলাফেরায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করো। (সূরা ৩১ লোকমান : আয়াত ১৯)
অর্থাৎ এমনভাবে দৌড়-ঝাপসহ চলো না যা সভ্যতা ও শালীনতার পরিপন্থী। রাসূল (স.) বলেন- “দ্রুতগতিতে চলা মুমিনের সৌন্দর্য্য ও মানহানিকর।” (জামে সগীর)

০২. দম্ভভরে না চলা : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করছেন- وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا
“পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণা করো না।” (সুরা-লোকমান : আয়াত ১৮)
অর্থাৎ আত্মাভিমানীদের ধারা অনুসরণ করে অহংকারভাবে বিচরণ করো না। কারণ দাম্ভিক অহংকারীর পরিণতি ভয়াবহ। রাসূল (স.) বলেন- “একদা এক ব্যক্তি নকশা করা দু’টি চাদর গায়ে দিয়ে প্রবল অহমিকার সাথে চলছিলো এবং এ অবস্থায় তার মধ্যে অহংকারী ভাব তৈরি হয়েছিল। ফলে এ ব্যক্তিকে জমিনে ধ্বসিয়ে দেয়া হলো : আর এ অবস্থায় সে কিয়ামত পর্যন্ত মাটির গভীরে বিলীন হতে থাকবে।” (বুখারি ও মুসলিম)
ঔদ্ধত্যের সাথে আত্মাভিমানীদের মতো চলাফেরা ইসলামি শিষ্টাচার বহির্ভূত। চলাফেরায় মধ্যে নম্রতা অবলম্বন করাই ইসলামি শিষ্টাচার।

০৩. দৃষ্টিকে নত রাখা : চলাফেরার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভদ্রতা হচ্ছে নিজের দৃষ্টিকে নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ হতে দূরে রাখা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করছেন-

قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ …….. وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ

“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেনো তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে ………. এবং ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেনো তাদের দৃষ্টিকেও নত রাখে।” (সূরা-আন নূর : আয়াত ৩০-৩১)
হযরত আবদুল্লাহ ইবেন মাসউদ (রা.) থেকে তাবারানী বর্ণনা করেন যে, রাসূল (স.) বলেন: আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “দৃষ্টিপাত শয়তানের একটি বিষাক্ত শর। যে ব্যক্তি মনের চাহিদা স্বত্ত্বেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল, সে অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করলো।”
রাসূল (স.) আরো বলেন- “ইচ্ছা ছাড়াই হঠাৎ কোনো বেগানা নারীর উপর দৃষ্টি পতিত হলে সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নাও।” (মুসলিম)
সুতরাং ইসলামি আদব হচ্ছে চলাফেরায় বা যে কোনো অবস্থায় পুরুষ অথবা নারী তাদের দৃষ্টিকে নত করে চলবে, যাতে কোনো নিষিদ্ধ দিকে দৃষ্টি না পড়ে।

বৈঠকী শিষ্টাচার
০১. বসার আদব : কোনো মজলিসে বসার নিয়ম শৃঙ্খলা বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত জাবির ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, “আমরা যখন রাসূলুল্লাহর (স.) দরবারে হাজির হতাম, তখন শেষের দিকের খালি জায়গায় বসে পড়তাম।” (আবু দাউদ)
অর্থাৎ মানুষকে ঠেলে অথবা মানুষের কাঁধের উপর পা দিয়ে সম্মুখে গিয়ে বসতে চেষ্ট না করে, যেখানে খালি পাওয়া যাবে সেখানেই বসা ইসলামি শিষ্টাচার। রাসূল (স.) ইরশাদ করেন-

لاَتَجْلِسْ بَيْنَ رَجُلَيْنِ اِلاَّ بِاِذْنِهِمَا

“দু’ব্যক্তির মাঝখানে বসো না।” (আবু দাউদ)
অর্থাৎ, কোথাও দু’জন লোক বসা থাকলে তাদের নিকট থেকে অনুমতি নেয়া ব্যতীত দু’জনের মধ্যবর্তী স্থানে বসবে না।
সুতরাং বসার ক্ষেত্রে ইসলামি শিষ্টাচার হচ্ছে, কাউকে না উঠিয়ে, না ডিঙিয়ে যেখানেই জায়গা খালি পাওয়া যাবে সেখানেই বসা।

০২. কানে কানে কথা না বলা : কোনো মুসলমানের মনে আঘাত লাগতে পারে এমন কথা কাজ ও আচরণ হতে বেঁচে থাকা ইসলামি শরীয়তের নির্দেশ। তিনজনের বৈঠকে দু’জনের এমন কানাকানি না করা যাতে তৃতীয়জন কষ্ট পায়। রাসূল (স.) বলেন-

اِذَا كُنْتُمْ ثَلٰثَةً فَلاَ بَتَنَاجِىْ اِثْنَانِ دُوْنَ الْاٰخَرِ حَتّٰى تَخْتَلِظُوْا بِالنَّاسِ مِنْ اَجَلٍ اَنْ يَحْزَنُهُ

“যখন তোমরা তিনজন একত্রে থাকবে, তখন তোমরা দু’জনে পরস্পরে অপরজনকে বাদ দিয়ে কানে কানে কথা বলবে না- যেই পর্যন্ত না তোমরা বহুলোকের সাথে একত্রিত হও। তা এজন্যে যে, এতে অপর ব্যক্তি মনঃক্ষুন্ন হবে।” (বুখারি ও মুসলিম)

০৩. হাঁচির শব্দকে নিচু রাখা : হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- “যখন রাসূলুল্লাহর (স.) হাঁচি আসতো তখন তিনি নিজের হাত বা কাপড় দ্বারা মুখ ডেকে ফেলতেন এবং হাঁচির শব্দকে নিচু রাখতেন।” (তিরমিযী ও আবু দাউদ)
অর্থাৎ হাঁচি দেয়ার সময় এদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে, যেনো শ্লেষ্মা অন্য কোনো লোকের গায়ে-মুখে না পড়ে এবং যথাসাধ্য হাঁচির আওয়াজকে নিচু রাখতে চেষ্টা করা।
হাইতোলার ক্ষেত্রে রাসূল (স.) বলেন, “যখন তোমাদের কারো হাই আসে, সে যেনো নিজের হাত মুখের উপর রাখে। কেননা সেসময়ে শয়তান মুখে প্রবেশ করে।” (মুসলিম)
অর্থাৎ কোনো বৈঠকে বসা অবস্থায় ‘হাই’ আসলে তখন তাকে যেকোনো উপায়ে রোধ করতে চেষ্টা করবে। আর তাকে প্রতিরোধ করার বিশেষ নিয়ম হলো, মুখের উপর হাত রেখে দেয়া।

আচরণগত শিষ্টাচার
০১. পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করা : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করছেন-

وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا………… وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ

“এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যাবহার করো। ……….. তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও।” (সুরা-বনী ঈসরাইল : আয়াত ২৩-২৪)
অর্থাৎ পিতা মাতার সাথে সর্বদা সদাচরণ করা, তাদের সামান্যতমও কষ্ট হয় এমন আচরণ থেকে বিরত থাকা এবং তাদের আদেশ নিষেধ মেনে চলাই হচ্ছে ইসলামি শিষ্টাচার।

০২. আত্মীয় স্বজনকে দান করা : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করছেন-

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَىٰ

“আল্লাহ ন্যায় পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়স্বজনকে দান করার আদেশ দেন।” (সুরা-আন নহল : আয়াত ৯০)
অর্থাৎ আত্মীয়স্বজনকে তার প্রাপ্য দান করা, তাদের সাথে সদাচরণ করা ইসলামি আদব।

০৩. অগ্রজ ও দ্বীনি দায়িত্বশীলদের সামনে অগণী না হওয়া: আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করছেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও রসূলের সামনে অগ্রনী হয়ো না।” (সুরা-আল হুজুরাত: আয়াত ১)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় কেউ কেউ বলেন, ধর্মের আলেম ও মাশায়েখ এবং ইসলামি সংগঠনের আমিরের বেলায়ও এই বিধান কার্যকর। অর্থাৎ তাঁদের সামনে নিজেকে আগ বাড়িয়ে দেয়া, তাঁদের কণ্ঠস্বরের উপর নিজের কণ্ঠ উঁচু করা ইসলামি শরীয়তে নিষিদ্ধ এবং শিষ্টাচার বর্জিত।

০৪. শিশুদের-ছোটদের স্নেহ করা : হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলের (স.) কাছে একটি শিশুকে আনা হলো। তিনি তাকে চুম্বন করলেন।” (শরহে সুন্নাহ)
হযরত আয়িশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- “হযরত ফাতিমা (রা.) যখন নবী করীমের (স.) কাছে আসতেন, মহানবী (স.) দাঁড়িয়ে যেতেন এবং হযরত ফাতিমার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চুম্বন করতেন এবং নিজের আসনে বসাতেন।”
অর্থাৎ শিশুদেরকে আদর করা এবং বয়সে ছোটদেরকে ¯েœহ করা ইসলামি শিষ্টাচার।

০৫. উত্তম নামে সম্বোধন করা: আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন- وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ
“তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না।” সুরা-আল হুজুরাত: আয়াত ১১)
অর্থাৎ, কেউ কোনো গুনাহ বা মন্দ কাজ করে তওবা করার পরও তাকে সেই মন্দ নামে ডাকা ইসলামি আচরণ হতে পারে না।

০৬. দু’জনের মধ্যে মিমাংসা করে দেওয়া: আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করছেন-

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ


“মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। অতএব তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মিমাংসা করবে।” (সুরা-আল হুজুরাত: আয়াত ১০)
এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, “আমি কি তোমাদের এমন কাজ সম্পর্কে বলবো না যার সওয়াবের মর্যাদা রোজা, সদকা ও নামাযের সওয়াব অপেক্ষা উত্তম! তখন সাহাবিরা বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ বলুন! তিনি বললেন, তা হলো : সম্পর্কচ্ছেদ দু’জনের মধ্যে আপোষ করে দেওয়া।” (আবু দাউদ, তিরমিযী)
সুতরাং অত্র উদ্ধৃতি থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, দু’জনের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হলে, তা মিটিয়ে দেয়া নফল নামায, রোযা, সদকা অপেক্ষা উত্তম। সর্বোপরি এটি ইসলামি শিষ্টাচারের অনুপম এক নির্দেশনা।

০৭. উত্তম আচরণ: হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূল (স.) বলেছেন- “সচ্চরিত্র, উত্তম চাল-চলন এবং মধ্যমপন্থা অবলম্বন নবুয়্যতের পঁচিশ ভাগের একভাগ।” (আবু দাউদ)
অন্যত্র ইরশাদ করছেন- “উত্তম চালচলন, ধীরস্থির পদক্ষেপ এবং মধ্যমপন্থা অবলম্বন নবুয়্যতের চব্বিশ ভাগের এক ভাগ।” (তিরমিযী)
অর্থাৎ উত্তম চালচলন, মধ্যমপন্থা অবলম্বন এবং ধীরস্থির পদক্ষেপ ইত্যাদি হচ্ছে ইসলামি শিষ্টাচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।