ইসলামী আন্দোলন ঈমানের অপরিহার্য দাবি

আবদুল হাফিজ খসরু

আল কুরআনে ইসলামকে অনেক জায়গায় ‘দ্বীন’ প্রতিশব্দে উল্লেখ করা হয়েছে যার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বাংলা পরিভাষা হচ্ছে ‘জীবনব্যবস্থা’। ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ঘোষণা করে বিদায় হজ্বের দিন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা এই আয়াতটি নাযিল করেছেন, ‘আজকের এই দিনে তোমাদের জন্য দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি নিয়ামতসমূহ পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে একমাত্র দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সুরা-আল মায়িদা: ৩)। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইসলামকে শুধু পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে ঘোষণা করেননি বরং সকল জীবনব্যবস্থার উপর ইসলামকে বিজয়ী করার ঘোষণাও দিয়েছেন। সুরা তাওবা-৩৩, সুরা ফাত্হ-২৮ ও সুরা সফ-৯ নং আয়াতে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে, ‘আল্লাহ তাঁর রাসুলদেরকে পাঠিয়েছেন হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ যাতে তাঁরা সকল জীবনব্যবস্থা বা মতবাদের উপরে ইসলামকেই বিজয়ী করেন। যদিও কাফের-মুশরেকরা তা অপছন্দ করে।’ কোন বিপরীত শক্তির উপর বিজয়ী হওয়ার স্বাভাবিক দাবীই হলো একটি সর্বাত্মক আন্দোলন, একটি প্রাণান্তকর সংগ্রাম ও একটা সার্বিক বিপ্লবী পদক্ষেপ। সুতরাং আন্দোলন, সংগ্রাম, বিপ্লব প্রভৃতি শব্দ ইসলামের আলোচনা বা জ্ঞান গবেষণায় নতুন করে আমদানী করা কোন শব্দ নয়। ঈমানের সাথে, ইসলামের মূল প্রাণসত্তার সাথে এই শব্দগুলো ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে আছে।

আরবী ‘আল হারকাতুল ইসলামিয়া’র বাংলা প্রতিশব্দ ইসলামী আন্দোলন। আধুনিক আরবী ভাষায় তা রাজনৈতিক পরিভাষা হিসেবেই প্রচলিত। যদিও আল কুরআনে এর নিজস্ব একটি পরিভাষা রয়েছে এবং তা হচ্ছে ‘আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ অর্থ্যাৎ আল্লাহর পথে জিহাদ। এখানে ‘জিহাদ’ শব্দটি ‘আন্দোলন’ শব্দটি থেকে অনেক ব্যাপক ও গভীর অর্থ বহন করে। আরবী ‘জিহাদ’ শব্দটি এসেছে ‘জুহুদ’ শব্দ থেকে। যার অর্থ যথাসাধ্য চেষ্টা-সাধনা, চূড়ান্ত প্রচেষ্টা, প্রাণান্তকর সাধনা প্রভৃতি। কুরআনিক পরিভাষায় ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’র অর্থ আল্লাহর পথে চূড়ান্ত ও প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানো। সে অর্থে একটি দেশের প্রতিষ্ঠিত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভৃতি অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে ইসলামী আদর্শের আলোকে নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত সংঘবদ্ধ ও সুসংগঠিত প্রচেষ্টাকেই ইসলামী অন্দোলন বলা যেতে পারে।

জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা ইসলামী আন্দোলন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের স: প্রতি ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর নির্দেশ আল্লাহ ও তাঁর রাসুল স:-ই আমাদেরকে দিয়েছেন এবং তা কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণাও দিয়েছেন। এর অস্বীকারকারীর ঈমান থাকতে পারে না। আল্লাহর নির্দেশ ও রাসুলের স: দেখানো পথ বাদ দিয়ে কেউ অন্য কোন পথ-পন্থা অবলম্বন করা মানে কুফরী করা। আর কেউ বাহ্যিক আমল-আখলাকের মাধ্যমে নিজেকে পাক্কা ঈমানদার-মুসলিম দাবি করলো কিন্তু জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজে শরীক হলো না কিংবা ইচ্ছাও পোষণ করলো না হাদীসের ভাষায় তার আচরণকে মুনাফিকী বলা হয়েছে, যার শাস্তি কুফরী থেকেও জঘন্য। মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে রাসুল স: বলেন, যে ব্যক্তি মারা গেল, কিন্তু জিহাদের ময়দানে অবস্থান গ্রহণ করেনি কিংবা অন্তরে জিহাদের ইচ্ছাও পোষণ করেনি, সে মুনাফিকীর মৃত্যুবরণ করলো।

ইসলামের মূল স্তম্ভ যেমন নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত প্রভৃতি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন ও পরিপূর্ণ হক আদায়ের জন্যও ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা বা খেলাফত ব্যবস্থা জারি থাকা আবশ্যক। আল্লাহর নির্দেশ ও রাসুলের স: সুন্নাহর পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রের মূল নেতৃত্বের আসনে ইসলামকে পৌঁছানো অবশ্যই প্রয়োজন। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আন্দোলনের মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব। রাসুলুল্লাহ স: এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রা: আমাদেরকে তা অর্জন করে দেখিয়ে গেছেন। রাসুলুল্লাহর স: ইন্তেকালের পর খোলাফায়ে রাশেদার বত্রিশ বছরের শাসন ছিল ইসলামী ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। পরবর্তিতে রাজতান্ত্রিক পদ্ধতির খেলাফত ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। রাজতান্ত্রিক এই পদ্ধতিতে শাসকশ্রেণি ব্যক্তিগতভাবে ফাসেক-জুলুমবাজ হলেও খেলাফত পরিচালনায় সেখানে কুরআন-সুন্নাহর মূলনীতিই অনুসরণ করা হতো। অর্থ্যাৎ রাষ্ট্রীয়ভাবে তাওহীদ বা আল্লাহর রবুবিয়্যাত প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাষ্ট্র পরিচালনায় আলেম-ওলামাদের কমবেশি তত্ত্বাবধান ছিল। সেখানে খলীফারা ছিলেন বিশ্বের সকল মুসলমানের ঐক্যের প্রতীক। এই খেলাফত ব্যবস্থা বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত নামেমাত্র হলেও অধিকাংশ মুসলিম দেশে জারি ছিল। যা পরবর্তীতে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী ও তার দোষররা ধ্বংস করে ছাড়ে।

আজ খেলাফত ব্যবস্থার বিলুপ্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় আল্লাহর রবুবিয়্যাতের অনুপস্থিতিতে দেশে দেশে মুসলিমরাই সবচেয়ে বেশি জুলুমের শিকার। মুসলিম দেশগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভৌগলিক সীমারেখা ও জাতীয়তার নিগঢ়ে আজ আবদ্ধ। উম্মাহ্ কেন্দ্রীক বৃহত্তম ঐক্য চিন্তার পরিবর্তে সা¤্রাজ্যবাদী চক্রান্তের শিকার হয়ে নিজেদের মধ্যে ফের্কাবাজী, দলাদলি ও রক্তারক্তিতে লিপ্ত মুসলিম রাষ্ট্রগুলো। ইসলাম বিদ্বেষী শক্তি বিগত প্রায় এক’শ বছরে মুসলমানদের যে পরিমাণ রক্ত ঝরিয়েছে, মুসলমানদের ভূমি দখল করেছে কিংবা ইসলামী তাহজিব তামাদ্দুনের ক্ষতিসাধন করেছে তার বিবরণ বর্ণনাতীত। শুধু তাই নয় ইসলামী খেলাফত ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে অমুসলিম জনপদেও মজলুমের কাতার দিন দিন ভারি হচ্ছে। পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার যাঁতাকল মানবিকতাবোধ কেড়ে নিয়ে মানুষকে শুধুমাত্র উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত করেছে। কর্পোরেট কালচার ভোগবাদী ও আগ্রাসী মানসিকতার এমন এক এলিট শ্রেণি তৈরি করছে যারা তাবৎ দুনিয়ার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ছড়ি ঘুরাচ্ছে। ব্যবসায়িক কিংবা মতাদর্শিক স্বার্থে তারা দেশে দেশে যুদ্ধ-বিবাদ, সংঘাত-সংঘর্ষ উস্কে দিচ্ছে। আক্রান্ত দেশ ও জনগোষ্ঠীর সম্পদ লুণ্ঠন করছে।

এমতাবস্থায় হারানো খেলাফত ব্যবস্থা পুনপ্রবর্তন করে সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার সামগ্রিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা অতীব জরুরি। এই জন্য মুসলমানদেরকেই সর্বপ্রথম এগিয়ে আসতে হবে, প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কারণ আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাদেরকে বিশ্ববাসীর প্রতি এই দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। সুরা আল ইমরানের ১১০ নং আয়াতে মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, ‘তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে অপরাপর জাতি-গোষ্ঠীর জন্য, বিশ্ববাসীর কল্যাণ সাধনের জন্য। তোমরা তাদেরকে সৎ কাজের নির্দেশ দিবে ও অসৎ কাজে বাধা দিবে আর নিজেরাও আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে।’ সৎ কাজের নির্দেশ দেয়া যতটা না কষ্টসাধ্য, তার চেয়েও বেশী কষ্টসাধ্য হচ্ছে অন্যায় কাজে বাধা দান করা। আর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া, প্রশাসনিক সহযোগীতা ছাড়া তা দুরূহ ব্যাপার। অর্থ্যাৎ আল্লাহর প্রতি যারা ঈমান আনার দাবি করবে তাদের প্রত্যেককেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার এ সুবিশাল ও কষ্টসাধ্য কাজের দায়িত্ব বহন করতে হবে। সুতরাং জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ তথা ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শামিল হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী দাবি। ফিক্হী ভাষায় তা ফরজে আইন বা ব্যক্তিগতভাবে ফরজ ইবাদত। এ বিষয়ে ওলামায়ে কেরামের দ্বিমত নেই।

আধুনিক যুগে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা বা খেলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থার কর্মপরিধি অনেক ব্যাপক এবং তা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও হতে হবে ব্যাপক ও বহুমুখী। যেমন দাওয়াত, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও আত্মশুদ্ধি, বৃদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক আন্দোলন প্রভৃতি ক্ষেত্র। তবে সকল ক্ষেত্রের পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি ছাড়া ইসলামী আন্দোলন কখনো পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় না, সফল হয় না। কোন একটি দল/গোষ্ঠী দ্বারাও উপরোক্ত বহুমুখি ক্ষেত্রে এককভাবে বিচরণ করাও সম্ভব হয় না। সবগুলো ক্ষেত্রের সম্মিলনই হতে পারে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আন্দোলন। যুগে যুগে এ বিষয়ে ওলামায়ে কেরাম জাতিকে পথ দেখিয়েছেন। রাসুলুল্লাহর স: জীবনাদর্শ পর্যালোচনা করে যুগের ওলামায়ে কেরাম জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা ইসলামী আন্দোলনের কাজগুলোকে কয়েকটি ক্ষেত্রে ভাগ করেছেন, যেমন:

জিহাদ বিল ক্বালব বা নফসের সাথে জিহাদ: আত্মশুদ্ধিমূলক কাজগুলো হচ্ছে জিহাদ বিল ক্বালব। সুনানে তিরমিজির এক হাদীসে নিজ নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রামকারীকেও রাসুল স: আল্লাহর পথে বীর মুজাহিদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ সন্দেহ-সংশয় ও দুর্বল ঈমান নিয়ে কেউ মুশরিকদের মোকাবেলায় সম্মুখ সমরে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না। দম্ভ-অহংকার, অসহিষ্ণুতা, লোভ-লালসা, প্রদর্শনেচ্ছা, জিঘাংসা, দুনিয়াপ্রীতি প্রভৃতি কলুষিত আত্মা নিয়ে জিহাদের ময়দানে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় সংঘবদ্ধ হয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। আল্লাহর দ্বীনকে সর্বোচ্চে তুলে ধরার সংগ্রামে যারা লিপ্ত হবে তাদেরকে চিরশত্রু শয়তানের ধোঁকা সম্পর্কে প্রতিনিয়ত সজাগ থাকতে হয়। নিজের কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানের সকল কুমন্ত্রণা থেকে বেঁচে থাকতে হলে অবিরাম যে জিহাদ প্রত্যেক মুজাহিদকে চালিয়ে যেতে হয় তা হচ্ছে জিহাদ বিল ক্বালব বা নফস ও শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ। কুরআনে অনেক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘যে তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করলো সে সফলকাম হলো।’

আত্মিক পরিশুদ্ধির সাথে সাথে আর্থিক কুরবানির প্রচেষ্টা চালানোও জিহাদ বিল নফসের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর পথে আল্লাহরই নির্দেশিত পন্থায় নিজের কষ্টার্জিত অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা প্রবৃত্তি পূজারি, লোভী ও কৃপণ ব্যাক্তি দ্বারা সম্ভব হয় না। সম্ভব নয় স্ত্রী-পুত্র-পরিজন ও সম্পদের মায়া পরিত্যাগ করে শাহাদাতের খুন রাঙা পথ মাড়িয়ে আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টির দিকে এগিয়ে যাওয়া।

আত্মাকে কলুষমুক্ত করতে সাহাবায়ে কেরাম রা. এবং বীর মুজাহিদগণ ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি নিয়মিত নফল নামায, তেলাওয়াত, রোযা, তাসবিহ ও জিক্র এবং আর্থিক কুরবানি বেশি বেশি করতেন। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্বকে খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতেন, মৃত্যুকে খুব নিকটেই মনে করতেন। কুরআন-হাদীসে বর্ণিত জান্নাত-জাহান্নামের চিত্র নিজেদের হৃদয়পটে সর্বদা ধারণ করতেন। নিজেদের সর্বোচ্চ ধন-সম্পদ ব্যয় করে যুদ্ধের ময়দানে দিনের বেলায় সশস্ত্র যুদ্ধ করতেন এবং রাতের বেলায় নফল নামাজে দাঁড়িয়ে দীর্ঘসময় কুরআন তেলাওয়াত করতেন, আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করতেন, ক্ষমা চাইতেন।

জিহাদ বিল লিসান বা কথা ও লেখনির মাধ্যমে জিহাদ : দাওয়াতে ইলাল্লাহ, দ্বীনি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ হচ্ছে এই ধরণের জিহাদের অন্তর্ভুক্ত। দ্বীনি মাদ্রাসা ও দ্বীনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে আধুনিক যুগের বিশেষজ্ঞ আলেম, দক্ষ প্রশাসক, বিচারক, আইন বিশেষজ্ঞ, আমলা, কূটনৈতিক, পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, ডাক্তারসহ ইসলামী রাষ্ট্র তথা খেলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার জন্য একদল দক্ষ জনশক্তি প্রস্তুত রাখাও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর অন্যতম ক্ষেত্র। এছাড়াও বিরুদ্ধবাদীগোষ্ঠীর যোগ্য, দক্ষ ও নেতৃস্থানীয় জনশক্তিকে ইসলামী আন্দোলনে শরীক করানোর নিরলস দাওয়াতি প্রচেষ্টাও এই জিহাদের অন্তর্ভুক্ত। সুরা আনফালের ৬০ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘আর প্রস্তুত কর বাতিল শক্তির সাথে যুদ্ধের জন্য যা কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যরে মধ্য থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শত্রুদের উপর।’

মক্তব, ওয়াজ মাহফিল ও তালীমী বৈঠকের মাধ্যমে সাধারণ মুসলমানের মাঝে দ্বীনি শিক্ষা ও সচেতনতা তৈরি, দাওয়াতে তাবলীগের মাধ্যমে অমুসলিমদের মাঝে ইসলামের আহ্বান ছড়িয়ে দেয়া, বই-পত্র, পত্রিকা ও সাহিত্য-সাময়িকীর মাধ্যমে শিক্ষিত সমাজে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণে জ্ঞানগর্ভ উপস্থাপনা, নাস্তিক ও ইসলাম বিদ্বেষী চক্রের বিরুদ্ধে বিজ্ঞান ও কুরআন-সুন্নাহর যুক্তিভিত্তিক মোকাবেলা প্রভৃতি কর্মকা-ও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা ইসলামী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। জালিমের বিপক্ষে ও মজলুমের পক্ষে দাঁড়িয়ে উচিত কথা বলা, সত্য সাক্ষ্য দেওয়া, খোদাদ্রোহী শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে তার অপশাসনের মৌখিক প্রতিবাদ করাকে রাসুল স: উত্তম জিহাদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইসলামের বড় বড় মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, ফিকাহবিদ, মুজতাহিদ ইমাম ও মুবাল্লিগগণ জিহাদ বিল লিসানের অগ্রসেনানী। তাঁরা সরাসরি সশস্ত্র জিহাদের ময়দানেও অবস্থান নিতেন আবার জিহাদ বিল লিসানেও শরীক থাকতেন। এ সমস্ত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ জালিম শাসকের চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কিন্তু আদর্শ থেকে একবিন্দু সরে যাননি, আপোষ করেননি কিংবা দরবারি আলেমে পরিণত হননি।

জিহাদ বিল ইয়াদ বা নিরস্ত্র প্রতিবাদি জিহাদ : কোন মুমিনের সামনে অন্যায় কাজ সংঘটিত হতে দেখলে তার প্রতি ঈমানের দাবি হচ্ছে যেকোন ভাবেই হোক ওই অন্যায় কাজে সে বাধা দিবে। কারণ কুরআনে ঈমানদারগণকে অসংখ্যবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দানের জন্য। মুসলিম শরীফের এক হাদীসে রাসুল স: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন কোন অন্যায় সংঘটিত হতে দেখে তাহলে তার প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে হাত দিয়ে বা শক্তি প্রয়োগে তা প্রতিরোধ করবে, যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে মুখের দ্বারা অথবা বক্তব্য/বিবৃতি দিয়ে তার প্রতিবাদ করবে আর যদি তাও সম্ভব না হয় তাহলে অন্তত মনেপ্রাণে সে অন্যায়কে ঘৃণা করবে। তবে মনে রাখবে এ হচ্ছে ঈমানের সর্বনি¤œ স্তর।’ আধুনিক যুগে প্রতিবাদী মিছিল, সমাবেশ, বক্তৃতা, লংমার্চ, অবরোধ, ঘেরাও প্রভৃতি কর্মসূচি জিহাদ বিল ইয়াদের অন্তর্ভুক্ত। তবে অবশ্যই সাধারণ মানুষকে জিম্মী করে, কষ্ট দিয়ে ও সম্পদের ক্ষতিসাধন করে এসব কর্মসূচি পালন করা ইসলামী আন্দোলন বা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ কখনো সমর্থন করে না।

জিহাদ বিস সাইফ বা সশস্ত্র প্রতিরোধ জিহাদ : আল্লাহর বিধান পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করতে গেলে, ইসলামের পূর্ণাঙ্গ দাওয়াত সর্বত্র পৌঁছাতে গেলে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ইসলাম চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে কিংবা খেলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থার চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করতে গেলে বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে চরম বাধা-বিপত্তি আসবে। কুফফার শক্তি, সেক্যুলার ও কায়েমী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর আঁতে ঘা লাগবে। এটা চিরন্তন সত্য। এই বাধা মোকাবেলার প্রথম স্তর হচ্ছে ধৈর্য্য-সহিষ্ণুতা। এরপর প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, জনমত গঠন ও প্রয়োজনে হিজরত। এরপরও যদি ইসলাম বিরোধীশক্তি বাধা দিতে থাকে, আক্রমণ পরিচালনা করে, উদ্ধত হয় তখনই কেবল ঈমানদারগণকে আত্মরক্ষার্থে সশস্ত্র প্রতিরোধের নির্দেশ দেয় ইসলাম। সুরা বাকারার ১৯৪ নং আয়াতে আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘বস্তুত যারা তোমাদের উপর জোর জবরদস্তি করে, আক্রমণ করে, তোমরাও তাদের উপর জোর জবরদস্তি করো, আক্রমণ করো, যেরুপ আক্রমণ তারা করেছে তোমাদের উপর।’ সুরা নিসার ৭৫ নং আয়াতে নির্যাতিত নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে উদ্ধারেও মুমিনদেরকে কিতাল বা সশস্ত্র যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও জমিনে ফেতনা-বিশৃঙ্খলা নির্মূলে প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বলা হয়েছে। কুরআনে এই জিহাদকে ‘কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ’ বলা হয়েছে এবং তা হচ্ছে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর চূড়ান্ত স্তর।

তবে সশস্ত্র জিহাদের নির্দেশনা আসতে হবে খলীফা বা রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে। যে ভূখ-ে ইসলামী খেলাফত কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত নেই সেখানে কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ তথা সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের ঘোষণা সংশ্লিষ্ট অঞ্চল বা রাষ্ট্রব্যবস্থার ওলামায়ে কেরাম ও ইসলামী নেতৃবৃন্দের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ঘোষণা করা হবে। তবে তা অনেকগুলো শর্তসাপেক্ষে। অন্যথায় ফেতনা-ফাসাদ বাড়বে, সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হবে এবং ইসলাম বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে বিজয় দূরূহ হয়ে উঠবে। অথচ কিতালের উদ্দেশ্য হচ্ছে চূড়ান্তভাবে জুলুমের অবসান, ফেতনা-বিশৃঙ্খলা নির্মূল এবং শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা। নি:সন্দেহে কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ হচ্ছে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ তথা ইসলামী আন্দোলনের চূড়ান্ত স্তর এবং ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ঈমানদারদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা সুরা নিসার ৭৬ নং আয়াতে বলছেন, ‘নিশ্চয় যারা ঈমানদার তারা সশস্ত্র লড়াই করে আল্লাহর পথে আর কাফেররা সশস্ত্র লড়াই করে তাগুতের পথে।’ সুতরাং কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ তথা রাজপথে প্রতিরোধী ইসলামী আন্দোলনকে অস্বীকারকারী ব্যক্তি কখনো মুমিন থাকতে পারে না।

প্রিয়নবী স: তেইশ বছরের নবুওয়্যাতি জীবনে প্রথম তের বছর মক্কায় কাটিয়েছেন। এই সময় ইসলামী আন্দোলনের উপরোক্ত প্রথম দু’টি ক্ষেত্র তথা জিহাদ বিল ক্বলব ও জিহাদ বিল লিসান পরিচালিত করেছিলেন। অর্থ্যাৎ দ্বীনি দাওয়াত, আত্মশুদ্ধি ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন। পরবর্তীতে মদীনায় হিজরতের পর বাকী দশ বছরে পরবর্তি দু’টিসহ জিহাদের সবগুলো ক্ষেত্রের কার্যক্রমই সমান্তরালভাবে পরিচালিত করেছিলেন। পাশাপাশি মদীনা কেন্দ্রীক প্রতিষ্ঠিত খেলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থাটি সুসংহত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অর্থ্যাৎ দ্বীনি দাওয়াত, প্রশিক্ষণ ও আত্মশুদ্ধি, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ, কুফফার শক্তির আক্রমণ প্রতিরোধ, মজলুম-নির্যাতিত মানুষের উদ্ধারে সশস্ত্র অভিযান এবং ইসলামী খেলাফতের প্রশাসনিক কর্মকা- একই সাথে পরিচালিত করেছিলেন। রাসুলের স: সব কাজই একসাথে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় বহন করে। তাঁর জীবনাদর্শের খ-িত কোন অংশ অনুসরণ কখনো ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ হতে পারে না। তাঁর জীবনে পরিচালিত সকল কার্যক্রমই পরিপূর্ণ ইসলামী আন্দোলনের কর্মসূচি।


রাসুলুল্লাহ স: এর এই আদর্শ সাহাবায়ে কেরাম রা: অনুসরণ করেছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর শোকে হতবিহ্বল অবস্থায় থেকেও সাহাবায়ে কেরাম রা: সর্বপ্রথম যে কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন তা হলো ইসলামী খেলাফতের দায়িত্বশীল নির্বাচন সম্পন্ন করা। আবু বকর রা:কে খলীফাতুর রাসুল বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর রাসুলুল্লাহ স: এর দাফন-কাফনের মত অতীব গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমটি সুসম্পন্ন করা হয়েছিল। সুতরাং ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহর দ্বীনকে সর্বোচ্চে তুলে ধরা এবং অপরাপর মতাদর্শের উপর ইসলামকে বিজয়ী করার সামগ্রীক আন্দোলনই জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ তথা ইসলামী আন্দোলন। আমাদের ঈমান কখনো পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না তা অস্বীকার করে। আমরা মনে করছি অতি সহজেই জান্নাতে চলে যাবো, অথচ আল্লাহ এখনও জানলেন না আমাদের মধ্যে কে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ তথা ইসলামী আন্দোলনের কাজ করছে এবং ধৈর্য্যধারণ করছে ? (সুরা আলে ইমরান-১৪২)। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের সকলকে তাঁরই পথে মজবুত মুজাহিদ হিসেবে গড়ে উঠার তাওফিক দান করুন এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তৌফিক দান করুন। আমীন।