চট্রগ্রামের একদম হৃদপিন্ডে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিরাট আকৃতির পাহাড়। এই পর্বতে কারো বাড়িঘর নেই। নেই কোন আত্মীয় স্বজন। তবু প্রতিদিন এই পাহাড়ে আরোহন করে কয়েক হাজার মানুষ। নর-নারী-বৃদ্ধ-কিশোর। নাম তার কোর্টহিল।
পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে রিক্সায় চলা বা পায়ে হাটা পথিকরা চেয়ে দেখে পিপড়ার সারির মতো নানা বর্ণের মানুষ উঠছে হাজারে হাজার। অন্য সারিতে মানুষ শুধু নামছে তো নামছেই। যেন মানবপিঁপড়ের লম্বা মিছিল।
সিলেট থেকে সদ্য আগত তরুণের কাছে চাটগামের বিচিত্র অভিনবত্ব যেন শেষ হচ্ছিলো না। তাই এই পাহাড়টি নিয়েও ছিলো আমার কৌতুহল।
১৯৯৮ সালে ইসলামী আন্দোলনের জন্য কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে আমাকে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম মহানগরীতে হিজরত করতে হয়।
এক সকালে সংগঠনের চট্রগ্রাম মহানগরী অফিসে আমাদের সাথে ছিলেন তিনি। তিনি কোর্টে তাঁর চেম্বারে যাবেন। উঠার সময় হঠাৎ বললেন, “আমার সাথে চলুন। কিছু সুধীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই আপনার।” চাকবাধা শ্রদ্ধা ছিল তাঁর প্রতি আমার অন্তরে। কোন বাড়তি প্রশ্ন ছাড়াই “জি আচ্ছা” বলেই সাথে চললাম তাঁর।
রিক্সা থেকে নেমে শুরু হলো পর্বত চূড়ায় উর্ধারোহন। বেশ কিছু সময়ে গন্তব্যে পৌছে দেখি ওখানে এলাহী কায়-কারবার। সমগ্র চট্টগ্রামের মানুষের ধন-দৌলত, জাগা-জমির নিরাপত্তা, বঞ্চিত, মজলুম এবং অন্য সবের অধিকার আদায়ের শেষ আশ্রয় এই পাহাড়টি।
আমি নেতা আহমদ সগীরের পিছু পিছু হাটলাম। তিনি আইনজীবিদের সব কটি বারে আমাকে নিয়ে চললেন। যে চেম্বারে, যে টেবিলের সামনেই তিনি যান, মুহুর্তেই সবাই দাঁড়িয়ে যায়। যেন কোন শিক্ষক তার ছাত্রদের ক্লাশরুমে প্রবেশ করেছেন। এডভোকেট মীর নাসির (সাবেক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী) দাঁড়ালেন, করমর্দন করলেন। আইনজীবি সমিতির সেক্রেটারী, আ.লীগ নেতা এড. শামসুল ইসলাম, বিএনপি নেতা দস্তগীর চৌধুরী, আইনজীবি নেতা এড. ফেরদৌস আহমদ, জামাত নেতা এড. জিয়া হাবিব আহসান, আইনজীবি নেতা এড. কাজী সাইফ উদ্দীনসহ বারের সকলেই দাঁড়িয়ে মুসাফাহা করতে লাগলেন। তিনি কোন চেম্বার বা টেবিলেই বসলেন না। তাঁর ডান পাশে থাকা আমার দিকে ইশারা করে চিটাগং এর ভাষায় শুধু বললেন, “ইভে আঁরার নোয়া নেতা। সিলেটততুন আঁরা উধর গরি আইননিদি। অনরলগে পরিচয় গরি দিলাম। অনারা তারে বুদ্ধি পরামর্শ ও সহযোগিতা গরিবেন।”
আমি এসব কান্ড-কারখানায় অবাক হচ্ছিলাম। মুচকি হাসি যথাসম্ভব লুকিয়ে মুসাফাহা করছিলাম আর সকলের ভিজিটিং কার্ড চেয়ে নিচ্ছিলাম।
তাঁকে তাঁর কোর্টের চেম্বারে রেখে সেদিন আমি একাই ফিরে আসলাম। সব ঘরানার বড় বড় মানুষের তার প্রতি এমন শ্রদ্ধা নিবেদন দেখে বিস্মিত হলাম। আমি চিন্তা ও ভাবাবেশে ডুবে গেলাম। তিনি চট্রগ্রাম আইনজীবি সমিতির সাবেক প্রেসিডেন্ট। তাঁর প্রতি মানুষের এমন অন্তরঙ্গ শ্রদ্ধা-ভালোবাসার দৃশ্যে চমকে উঠলাম। আমি তো তাঁকে আগে থেকেই শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আজ বুঝলাম, আমার ঐ শ্রদ্ধার পরিমান মোটেই যথেস্ট নয়। আমার ধারনা ও শ্রদ্ধার চেয়েও তাঁর উচ্চতা অনেক উপরে। এরপর আরো অনেকবার যাই সেই কোর্টহিলে। সে সব দিনে তিনি না সাথে না থাকলেও সেখানে অভ্যর্থনা কমেনি আমার একটুও।
কেন্দ্রীয় সভাপতি মু্নতাসির ভাই ১৯৯৯ সালে আবার কারাবন্দী হলেন। প্রতিবাদ, বিক্ষোভ চললো সবখানে। আমার উপর তখন চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতির দায়িত্ব। সদস্য বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো চুড়ান্ত প্রতিবাদ সমাবেশ হবে ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে। পরিকল্পনা চুড়ান্ত করে কন্টিনেন্টালে কেন্দ্রে কপি পাঠিয়ে তাঁর কাছে গেলাম। প্লান বলার পর পরই তিনি চেহারা বেজার করে বসে থাকলেন। যেন আমি কোন ভুল করে ফেলেছি। এমন দেখে মনে মনে আমিও তার উপর বিরক্তিবোধ করলাম। ছাত্র মজলিসের প্রোগ্রাম। এখানে তাঁর অখুশী হবার কী?
কয়েক মিনিট পর বললেন আরে নেতা! লালদীঘি ময়দানে এত বড় আয়োজনের সাহস কেমনে করলেন? বিশাল বাজেট, অনেক বড় প্রস্তুতি। এত বড় আয়োজন। আমি কেমনে কি করবো বলেন? তাঁর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলাম না। আরো কিছু কথার পর বুঝলাম, আর্থিক বাজেটের টোটাল টেনশনটা তাঁর মাথায়ই নিচ্ছেন। আমি বিরক্তির পরিবর্তে এবার অবাক হলাম। ভেতরে ভেতরে সুখ অনুভব করে বললাম আপনি দোয়া করে ইজাযত দিয়ে দিন। আমরা মাঠে নেমে যাই ইনশাল্লাহ। বললেন, আরে আঁরার নেতা দেখি অনেক সাহসী। নামুন আল্লাহ ভরসা।
আমরা আন্দর কিল্লা মসজিদের চার পাশে মাইকের চোঙ্গা বেধে এক সপ্তাহ যাবত সকাল-সন্ধ্যা পাবলিসিটি চালালাম। সিঁড়ির নিচের চিপায় মাইকের মেশিন বসিয়ে ৪ জন কর্মীকে ১ ঘন্টা করে বাই-সাইকেল দায়িত্ব প্রদান করলাম। (তাদের জন্য কলা, পাউরুটি আর পানির বোতল মজুদ ছিলো। তাদের একজন মাইক্রোফোনে আর তিন জন লিফলেট বিতরণে মশগুল থাকতেন) মাত্র সাত দিনে তিন দিকের রাস্তায় চলা অন্তত এক লক্ষ মানুষ আমাদের প্রতিবাদ ও আহাজারি শুনতে পায়। প্রতিদিন আসরের পর আন্দরকিল্লা মসজিদের উচুঁ সিড়িতে দাড়িয়ে ঐ চোঙা দিয়েই মিনি প্রতিবাদ সভা করে নিতাম। এসবে সগীর সাহেবও এসে যোগ দিতেন। আমরা খুশী হয়ে যেতাম। অনেক উৎসাহ-আগ্রহ নিয়ে উত্তর জেলার নিয়াজ ভাই, নোমানী ভাই, দক্ষিণ জেলার জয়নাল ভাই ও হোজাইফা ভাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুস্তফিজ ভাই ও ইমন ভাইসহ সকল দ্বীনি ভাইয়েরা মিলে আমরা প্রোগ্রাম সফল করলাম।
১৯৯৯ সাল। সরকারের দমন, জুলুম-নিপীড়ন, গ্রেফতার, হুলিয়ার প্রতিবাদে আমরা সারা বছরই মাঠে। লালদীঘি ময়দান, চকবাজার মোড়, কাজির দেউড়ি মোড়, সিরাজুদ্দৌলা রোড, জামালখান রোড ও আন্দরকিল্লা মসজিদ চত্বর, আন্দরকিল্লার সিঁড়ি ও পুলিশের ধাওয়া, অন্ধকার চিপাগলিতে লুকিয়ে থেকে আবার খন্ডমিছিল, টিয়ারগ্যাস, পুলিশের হ্যান্ডকাপ, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার আর পুলিশের সাথে শিয়াল-মুরগী সম্পর্কের মধ্য দিয়েই যাচ্ছিলো গভীর উত্তেজনার দিন। সারাদিন রাজপথে শ্লোগান, ঘামে জবুতবু আর রাতে গোসল করে একটুখানি ফ্রেস হওয়ার চেষ্টা। আমরা বাইরে একা বা ছোট দলে হাটতাম না। পুলিশী ছোবলের ভয়ে। এ রকম মুসীবতের এক বিকেলে তাঁর একটি ছোট্ট চিরকুট পৌছলো আমার হাতে। “মনজুরে মাওলা ভাই, আজ সন্ধ্যা ঠিক ৭টায় নগরীর বহদ্দার হাটের অমুক ঠিকানায় পৌছতে হবে। শুধু একজনকে সাথে নেয়া যাবে।”
আমরা দুইজন নির্দিষ্ট ঠিকানায় গেলাম। একজন বড় শিক্ষাবিদের বাসা। দেখি ছাত্রদলের নাজিম উদ্দিন, দীপ্তিসহ চার দলের বাকী তিন ছাত্র সংগঠনের নেতারাও দুই জন করে হাজির। আন্দোলনের ক্রমাগত বহু নেতাকর্মী গ্রেফতারের প্রেক্ষিতে উদ্বিগ্ন সবাই। তবু শেষ সাহস সম্বল করে সিদ্ধান্ত হল এখন থেকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। “মন্ত্রের সাধন নয়তো শরীর পতন”। এই ঐতিহাসিক বৈঠক থেকেই গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য। ফলাফল আসলো দারুন। এখন আর পুলিশকে নয়; পুলিশই আন্দোলকে ভয় করতে লাগলো। আগে আলাদা থাকতে রোজ ৩-৪ জন নিয়ে যেত। এখন হাজার হাজার তরুণের বাধভাঙ্গা মিছিলে পুলিশ নিরাপদ দূরে দাঁড়ায়। ঢাকায় এই ছাত্রঐক্যের শক্তির প্রভাব পড়ে। আমরা চিটাগাং থেকে ঢাকায় যাই। বেগম খালেদা জিয়া, এইচ এম এরশাদ, শায়খুল হাদীসসহ চারদলের শীর্ষনেতার সাক্ষাত করি। আমাদের ফলাফলে তারা খুশী হন। এরই ধারাবাহিকতায় কিছুদিন পর ঢাকায় গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য। এই বিরাট ইতিহাসের গোড়ায় রয়েছে শ্রদ্ধেয় নেতা আহমদ সগীরের স্মৃতি।
তিনি সেই পঞ্চাশের দশক থেকে রাজনীতি আর দেশপ্রেমের সংগ্রাম করে আসছেন। তিনি তমদ্দুন মজলিসে কাজ করেন। ৬০ এর দশকে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠায় যুক্ত হন। তিনি খেলাফতে রব্বানীর কাজে সক্রিয় হন। হাফেজ্জী হুজুর তওবার রাজনীতি নিয়ে মাঠে আসলে তিনি চট্টগ্রামে খেলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এরপর মেজর জলিলের সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদে সামনের কাতারে এগিয়ে আসেন। ওলামায়ে কেরামের সকল আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ছিলেন। ১৯৮৯ সালে খেলাফত মজলিস গঠিত হলে তিনি শুরু থেকেই মহানগর সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন। এর পর মহানগর সভাপতি এবং ২০০২ সাল থেকে শেষ দিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সংগঠনের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁকে নিয়ে আজো জ্বলছে আমার অনেক স্মৃতির জোনাকি। সেশন শেষে কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলনে রিপোর্ট নিয়ে যাবো। কেন্দ্রীয় বায়তুল মালের কোটা আমাদের বাকী রয়ে গেছে। সদস্যরা সবাই আলাদা ভাবে চাঁদা দিলেন। মোরশেদ ভাই নোয়াখালীতে তার বাড়ী গেলে তার আম্মা নাকের দুল দিয়ে দিলেন। তবু কোটা পুর্ণ হলো না। শেষ বিদায়ে সগির সাহেবের কাছে দোয়া নিতে গেলাম। সে সাথে কেন্দ্রীয় কোটার অপুর্ণতার কথা বললাম। তিনি রাজধানীর কাওরান বাজারস্থ টিকে ভবনের মালিকের কথা উল্লেখ করে তার কাছে যেতে বললেন। আমি ঢাকা এসে সেখানে গিয়ে তাঁর সালাম জানালাম। এরপর বায়তুল মালের পুর্ণ কোটা জমা দিলাম।
অফিসে কোন জিনিষ লাগবে, আহমদ সগীর। বিদ্যুৎ লাইন কেটে দিছে, আহমদ সগীর। নক্কাশ মাইকের বিল বাকী, আহমদ সগীর। কেন্দ্রীয় মেহমানের টিকেট, সফর খরচ, আহমদ সগীর। আমি এগুলো তার কানে পৌছাতে চাইতাম না। কিন্তু তিনি খোঁজে খোঁজে জেনে ফেলতেন।
আজকের মত আমাদের ছিলো না কোন মোবাইল ফোন। কেন্দ্র থেকে তারিখ দিয়ে ল্যান্ড ফোনে কথা হতো। তার কাছে আগের দিন খবর আসলে তিনি আমাদের জানাতেন। আমরা দায়িত্বশীলরা পরদিন তাঁর বাসায় গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষায় বসে রইতাম। এরপর মুনতাসির ভাই, জয়নুল ভাইর কন্ঠ ও নির্দেশনা শুনে আমরা মনভরে ফিরে আসতাম।
হাজার স্মৃতি ঝাপি নিয়ে প্রিয় চট্টলা থেকে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে আমি আবার ঢাকা মহানগরীতে স্থানান্তরিত হয়ে গেলাম। চট্টগ্রাম থেকে বিদায় নিয়ে আসলেও আমার প্রতি তাঁর স্নেহ এতটুকু কমেনি। শুরা অধিবেশনে তিনি কমপক্ষে ২ বার ঢাকা আসতেন। ঢাকা অবস্থান কালিন তার থাকার ঠিকানা ছিলো সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়শনের সুসজ্জিত ডরমিটরী। অথবা রাজারবাগের পরিপটি হোয়াইট হাউস। আমি ছাড়া তাঁর যেন থাকাই হতো না। আমার জন্য সেখানে থাকতো তার সমান আয়োজন। তিনি ঢাকা আসলেই আমার মেসের মিল ও থাকা বন্ধ থাকতো। তাঁর ছেলে ইমন ভাই (বর্তমানে সিডিএর নির্বাহি প্রকৌশলী) বুয়েটে পড়তেন। সেই বুয়েটের হলে গেলেও আমাকে ছাড়া যেন তার যাওয়া হতো না।
শ্রদ্ধেয় নেতা আহমদ সগীর!
আপনার দিল উজাড় করা স্নেহ আর দ্বীনি মহব্বত আমাকে রেখেছে আজ শোকার্ত করে। কীভাবে ভুলবো আপনার উচ্চতার কথা। আপনার অজস্র ভালোবাসার স্মৃতিময় গল্পমালা।!
এই মুহুর্তে আমার কামনা, আল্লাহ আপনার সমস্ত সুকৃতির লায়েক জাযা দিন। বর্তমান ঠিকানায় উত্তম মেহমানদারী করুন।
হে সংগ্রামী বীর,
এবার বিশ্রাম নিন।
লেখক- মাওলানা মনজুরে মাওলা
সাবেক কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক