আজ থেকে ৩০ বছর পূর্বের কথা। দেশ জুড়ে চলছিল রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা । স্বৈরাচার এরশাদের পতনের জন্য দল -মত নির্বিশেষে সকলেই একযোগে আন্দোলন চালাচ্ছিল । এদেশের তাওহিদী জনতার আধ্যাত্মিক রাহবার হাফেজ্জী হুজুরের (রহ) সাহসী নেতৃত্বের মধ্য দিয়েই এরশাদ পতনের আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন শক্তিশালী হতে থাকে। সরকারের দমন নিপীড়নও বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতিতেও একদল সত্যান্বেষু তরুণ ভুলে যায়নি তাদের স্বপ্নের কথা। তারা স্বপ্ন দেখছিল এই কালেমাযুক্ত সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন করার। তারা প্রত্যয় নিয়েছিল এই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের শান্তিপূর্ণ এক স্থায়ী পরিবর্তনের ,এক নতুন সমাজ বিনির্মাণের ।যে সমাজে থাকবে না কোন জুলুম, নির্যাতন । থাকবে না ক্ষমতালোভী কোন শাসক। যেখানে শাসক হবে ন্যায়পরায়ণ ।আমানতের পূর্ণ হেফাজতকারী, পরিচালনা করবেন পূর্ণ জবাদিহীমূলক সরকার ব্যবস্থা । ধনী দরিদ্র থাকবেনা কোন ভেদাভেদ । যে সমাজের পুরো কাঠামো হবে খোলাফা আলা মিনহাজিন নবুয়তের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত ।
তাই তারা তৎকালীন সরকার ও প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৯০ সালের ৫ জানুয়ারী জড়ো হয়েছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে । শিশিরভেজা ভোরের ঝলমলে আলোয় মিনারের পাদদেশে দাড়িয়ে দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন , ” আমরা নিরব হবো না, নিথর হবো না, নিস্তব্ধ হবো না যতদিনে আল কোরআনকে সংবিধান পাবো না “। এই ঘোষণার মধ্যদিয়ে ধ্বনিত হয়েছিল নতুন একটি উচ্চারণ ” বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস “।
ইতোমধ্যে গত হয়েছে ২৯টি বছর । রচিত হয়েছে দীর্ঘ একটি ইতিহাস । এই নামের সাথে পরিচিত হয়েছে হাজারো ছাত্র জনতা। ভালবেসেছে এই নামটিকে। ঐকমত্য পোষণ করেছে এর আদর্শ ও কর্মসূচির সাথে। প্রত্যয় গ্রহণ করেছে কোর আনের রাজ কায়েম করতে। জীবন দিয়ে শহীদ হয়েছে এই কাফেলায় শরীক হয়ে। এভাবেই বাংলার সবুজ ক্যাম্পাসগুলোকে মুখরিত করেছে এই কাফেলার অগ্রজ ভাইয়েরা । (শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাদের, আল্লাহ তাদের উত্তম বিনিময় দান করুন ।)
কখনো জেগে উঠেছে প্রতিবাদী আওয়াজে আমাদের অগ্রজ ভাইয়েরা । ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাগুতর বিরুদ্ধে । ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ গুড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলন, ৯৪’ সালের তসলিমা নাসরিন বিরোধী আন্দোলন, পার্বত্য চট্রগ্রাম শান্তিচুক্তির প্রতিবাদে গড়ে তুলেছিলেন জোড়ালো আন্দোলন । ফতোয়া বিরোধী রায়ের প্রতিবাদসহ সর্বশেষ ব্লগার নাস্তিক, মুরতাদদের বিরুদ্ধে সকল ছাত্র সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে ইসলামী ছাত্র মজলিস। ইসলাম ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ আন্দোলনে অংশ নিয়ে শাহাদাত বরণ করেন এ কাফেলার ৭ (সাত) জন ভাই। আল্লাহ তাদের মর্যাদা বুলন্দ করুন।
ছাত্রদের নিয়েই আমাদের স্বপ্ন ,আমাদের আন্দোলন । তাই ইসলামী ছাত্র মজলিস ছাত্র সমাজের সমস্যা সমাধানে প্রতিষ্ঠালগ্ন হতেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে । বিভিন্ন সময় ছাত্রদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে পাশে দাড়িয়েছে । সন্ত্রাসমুক্ত নিরস্ত্র ক্যাম্পাস গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । আমরা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি, তাত্ত্বিক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার পাশাপাশি একজন ছাত্রের নৈতিক ও চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে যাতে সৎ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সে লক্ষ্যে সর্বক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করণের দাবিসহ ১৩ দফা শিক্ষা দাবি প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ফাযিলের ডিগ্রি এবং কামিলের মাস্টার্স মান ও কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি বাস্তবায়ন হয়েছে।
ইসলামী ছাত্র মজলিস সর্বপ্রথম কওমি সনদের স্বীকৃতির দাবি উপস্থাপন করেছিল। যখনই শিক্ষা কাঠামো থেকে ইসলামকে উপেক্ষা বা পুরোপুরি বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে তখনই ইসলামী ছাত্র মজলিস তার বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছে । শিক্ষানীতি ২০১০ ও শিক্ষা আইন ২০১৬ বাতিলে দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল ইসলামী ছাত্র মজলিস।
এই ২৯ বছরের পথ চলার মধ্যদিয়ে ইসলামী ছাত্র মজলিস প্রমাণ করেছে কোন জুলুম নিপীড়ন ,লোভ লালসা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের চলার পথকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। শত বাধা আর বিপর্যয়ও তাদের চেতনা থেকে চুল পরিমাণ বিচলিত করতে পারে না। তারা দৌড়ে চলে তাদের গন্তব্যের দিকে। তারা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলে আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে। সে গতিতেই এগিয়ে চলছি আমরা। আমরা কখনো পেছনে ফিরে থাকাইনি। হতাশা কখনো স্পর্শ করতে পারে নি আমাদের ।অর্ধাহারে অনাহারে হাড়ভাংা পরিশ্রমের বদৌলতে আমাদের অগ্রজ ভায়েরা গড়ে তুলেছেন সমাজ বিপ্লবের নির্মল ও মজবুত একটি কাফেলা ।
যার শিকড় প্রোথিত হয়েছে এই মাটির গভীর গহীনে । কেউ চাইলেই উপড়ে ফেলতে পারবে না। কোন ষড়যন্ত্র এর গতিপথ স্থব্ধ করতে পারেনি । আমরা ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনই করছি ।মহানবী (সা) আদর্শের ফেরিওয়ালা হিসেবেই মাদ্রাসা ,স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ,মাঠে ময়দানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কোন তাগুতি শক্তি আমাদেরকে রুখে দিতে পারবে না ইনশাআল্লাহ ।
পেশিশক্তি আর পার্থিব লোভ লালসার বিপরীতে জ্ঞান, চরিত্র আর মাধুর্য দিয়ে ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে আমাদের পথচলাকে আরো গতিশীল করতে হবে। আমাদের এই মিশনকে মনজিলে মকসুদে নিয়ে যাওয়ার জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে কোরবানির নাজরানা পেশ করতে হবে। প্রয়োজনে কোরবানি করতে হবে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রিয় বস্তুকে । তবেই সফল হবে আমাদের পথচ্য। সার্থক হবে আমাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ।
লেখকঃ সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস