بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
أَحَسِبَ ٱلنَّاسُ أَن يُتْرَكُوٓا۟ أَن يَقُولُوٓا۟ ءَامَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ
وَلَقَدْ فَتَنَّا ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۖ فَلَيَعْلَمَنَّ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ صَدَقُوا۟ وَلَيَعْلَمَنَّ ٱلْكَٰذِبِينَ
বঙ্গানুবাদ :
মানুষ কি মনে করে নিয়েছে যে, আমরা ঈমান এনেছি এ কথাটুকু বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? অথচ আমি তাদের পূর্ববর্তীদের সকলকেই পরীক্ষা করে নিয়েছি। আল্লাহ তা’য়ালা অবশ্যই দেখবেন কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যুক।
নামকরণ:
সূরা আনকাবুতের চতুর্থ রুকুর ৪১ নম্বর আয়াতের ‘আনকাবুত’ শব্দ হতে এই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। ‘আনকাবুত’ শব্দটির অর্থ ‘মাকড়সা’। সূরার এই নামকরণ করা হয়েছে কোনো শিরোনাম হিসেবে নয়। অন্যান্য সূরার ন্যায় এটিও প্রতীকি নামকরণ। তবে এই নামকরণে অবশ্যই ওহীর নির্দেশ রয়েছে। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিজস্ব কোনো চিন্তা থেকে সূরাসমূহের নামকরণ করেননি।
নাজিলের সময়কাল:
সূরাটি মক্কী সূরা। যদিও সূরার প্রথম দিকে মুনাফিকদের প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে বিধায় প্রথম দশটি আয়াত মাদানী বলে কোনো কোনো তাফসীরকারক মনে করেন। কেননা মুনাফিক ছিল মক্কাতে নয়; মদীনাতে। তবে অধিকাংশের মতে যেসব মুনাফিক লোকের কথা বলা হয়েছে তারা সে সকল মুনাফিক যারা মক্কার কাফিরদের জুলুম নির্যাতন থেকে বেঁচে থাকার জন্য মুনাফিকী অবলম্বন করেছিল। এ সূরাতে মুসলমানদের হিজরত করতে বলা হয়েছে বলে কোনো কোনো তাফসীরকারক একে মক্কী জীবনের শেষ দিকের সূরা বলেছেন। এসব ধারণাবশত বক্তব্যের মূলে কোনো হাদিসের প্রমাণ নেই। সূরাটি উল্লিখিত বিষয় ও বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করেই এসব ধারণা প্রকাশ করা হয়েছে। (আল্লাহপাকই ভালো জানেন)
শানে নুযুল বা অবতরণের কারণ:
মক্কায় মুসলমানদের ওপর চরম নির্যাতন চলছিল। কাফেররা পূর্ণশক্তিতে ইসলামের বিরোধিতা করছিল। যেই ইসলাম কবুল করে রাসূলের (সা) দলে যোগদান করতেন তার ওপরই চরম বিপদ-আপদ ও জুলুম-নির্যাতনের স্টিম রোলার চলতো। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা’য়ালা এ সূরাটি নাজিল করেন। এ সূরার মাধ্যমে আল্লাহ তা’য়ালা প্রকৃত নিষ্ঠাবান ঈমানদারদের দৃঢ়সংকল্প, অনড় মনোবল, সাহস-হিম্মত ও অনমনীয় মনোবল সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। সাথে সাথে দুর্বল ঈমানদার লোকদেরকে লজ্জা দিতে চেয়েছেন। একই সাথে মক্কার কাফেরদেরকে কঠোর ভাষায় শাসন করা হয়েছে। তাছাড়া অতীতের নবী রাসূলদের ওপর অমানষিক জুলুম নির্যাতনের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এ সূরায়। নির্যাতন সহ্য করে যারা সত্য ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে টিকে ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে সাহায্য করা হয়েছে। কঠিন পরীক্ষার একটা পর্যায় অতিক্রম করার পরই আল্লাহর সাহায্য আসবে। ঈমানের সেই অগ্নি পরীক্ষা দিয়েই আল্লাহর জান্নাতে যেতে হবে। এ কথাটি মক্কার মুসলমানসহ যুগে যুগে সকল মুমিন মুসলমানদেরকে শিক্ষা দিতেই এ সূরার অবতারণা।
আলোচ্য আয়াতদ্বয়ের মূল বক্তব্য:
মুখে মুখে ঈমানের দাবি করলেই ঈমানদার হওয়া যায় না। ঈমানের দাবি পূরণ করতে সদা-সর্বদা তৈরি থাকতে হবে। আল্লাহ পাক ঈমানদারদের অবশ্যই পরীক্ষা করবেন। পূর্বের নবী-রাসূল এবং ঈমানদারদেরকেও আল্লাহ পরীক্ষা করেছেন। ঈমানের প্রকৃত দাবিদার কারা এ ব্যাপারে সত্য-মিথ্যা যাচাই করার প্রয়োজন রয়েছে। ঈমান যত বড় পরীক্ষা তত বড় হবে এটা জেনেই ঈমানের দাবি করতে হবে। পূর্বেকার সকল নবী-রাসূল এবং ঈমানদারদের থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
ব্যাখ্যা:
এখন আলোচ্য আয়াতের সংক্ষিপ্ত ব্যাখার দিকে মনোযোগ দেয়া যাক।
২ নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন, “মানুষ কি মনে করে নিয়েছে যে, আমরা ঈমান এনেছি এ কথাটুকু বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না?” এ আয়াতের ব্যাখ্যা জানার আগে জেনে নেয়া ভালো আল্লাহ তা’য়ালা যখন এ আয়াত নাজিল করেছিলেন তখনকার অবস্থা। ইসলাম গ্রহণকারীরা যদি গরিব কিংবা দাস-দাসী হতো তা হলে তাদের ওপর নির্যাতনের পাহাড় ভেঙে পড়তো। ছোট ব্যবসায়ী, কারিগর হলে রুজি রোজগারের সকল পথ বন্ধ করে দেয়া হতো। আর প্রভাবশালী হলে নানাভাবে কষ্ট ক্লেশ অপপ্রচার মিথ্যা অভিযোগ এমনকি তার গোটা পরিবার ধ্বংস করে দেয়া হতো। এরূপ অবস্থায় মক্কা নগরীর গোটা পরিবেশই ভয় আর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। এই অবস্থায়ও মজবুত ঈমানদার লোকদের মানবীয় প্রকৃতির স্বাভাবিক দাবিতে তাদেরও প্রায় কঠিনভাবে প্রাণ কেঁপে উঠতো, যদিও তারা ঈমান ছাড়েননি।
নবীর (স:) সাহাবী হযরত খাব্বাব ইবনে আরাত (রা:) পেশায় ছিলেন সামান্য কর্মকার। এমনই একজন পাক্কা মুমিনের অবস্থা বর্ণনা করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে মুমিনদের অবস্থা কী হয়েছিল। হযরত খাব্বাব বলেন, যে সময় কাফের মুশরিকদের অত্যাচার জুলুম নির্যাতনে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, তখন একদিন আমি রাসূলে কারীম (স:) এর সামনে উপস্থিত হলাম। হুজুর তখন কা’বা ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। আমি বললাম, আপনি কি আমাদের জন্য দোয়া করবেন না? (আলা তাদ’উ লানা আও আলা তাসতানসিরু লানা)
আমার এ কথা শোনা মাত্রই হুজুর (স:) উঠে বসলেন। তখন তাঁর চেহারা মুবারক রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। নবীজি বললেন, শোনো খাব্বাব! তোমাদের ওপর সেই কষ্ট অত্যাচার এখনো আসেনি যা তোমাদের পূর্বেকার নবী-রাসূল ও ঈমানদারদের ওপর করা হয়েছে। কাউকে কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে করাত দিয়ে দ্বি-খণ্ডিত করা হয়েছে। আবার কারো হাড়ের গোশত লোহার চিরুনি দিয়ে ছেঁচে ফেলা হয়েছে। এসবের কারণ ঈমানদারদেরকে ঈমানের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখা। কিন্তু প্রকৃত ঈমানদার জীবন দেবে তবুও ঈমানের পথ থেকে ফিরে যাবে না। পাক্কা মুসলমান কখনো মাথা নত করতে জানে না। বাতিলের হুংকার, রক্তচক্ষুর ভয় করে না মজবুত ঈমানদারেরা।
মুসলমানদের অভিভাবক হলেন আল্লাহ। মুসলমানদের নেতা হলেন নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স:)। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন। আর যারা কুফুরি করে, তাগুত (শয়তান) তাদের অভিভাবক। তারা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারের দিকে বের করে আনে। এরাই হলো জাহান্নামী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।” (সূরা বাকার : ২৫৭)
সুতরাং আল্লাহ অভিবাবক হলে মুসলামানদের ভয় কিসের? দৈহিক নির্যাতন, মানসিক অস্থিরতা এবং কাতর অবস্থাকে ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার পানি দিয়ে ঠাণ্ডা করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’য়ালা যুগে যুগে সকল ঈমানদারদের এই বার্তা দিয়ে বুঝাচ্ছেন যে, “লোকেরা কি মনে করেছে যে, ঈমান এনেছি বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে অথচ পরীক্ষা করা হবে না?”
দুনিয়া আখেরাতের সফলতা সম্পর্কে যেসব ওয়াদা রয়েছে, তা ঈমানের মৌখিক দাবি দ্বারা পাওয়া যায় না। এজন্য প্রয়োজন ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা। অগ্নি পরীক্ষা দিয়েই ঈমানের সত্যতার প্রমাণ পেশ করতে হবে। জান্নাতে যেতে হলে ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা বড় শর্ত। জান মালের ক্ষতি স্বীকার করতে হবে। শত অন্যায়, জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে হবে। বিপদ-আপদ, ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হবে। একদিকে থাকবে ভয় ও অপরদিকে লালসা- এসবের মধ্যেই ঈমানদারের পরীক্ষা হবে। তদুপরি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য অতি প্রিয় জিনিস কুরবানী করতে হবে। আল্লাহ বলেন,
لَن تَنَالُواْ الْبِرَّ حَتَّى تُنفِقُواْ مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنفِقُواْ مِن شَيْءٍ فَإِنَّ اللّهَ بِهِ عَلِيمٌ
কস্মিণকালেও কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে তোমরা ব্যয় না কর। আর তোমরা যদি কিছু ব্যয় করবে আল্লাহ তা জানেন। [ সুরা ইমরান ৩:৯২ ]
বর্তমান সময়ে এ আয়াতের আলোকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় শয়তানের প্ররোচনায় যারা আল্লাহ, কুরআন, নবী (সা)-কে নিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলছে তারা নবীর ওয়ারিশ এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকেও বিভিন্নভাবে ভয় দেখাতে চাচ্ছে। ঈমানদারদের কাছে এসব কিছুই না। তারা এর পরোয়া করে না। তারা বিশ্বাস করে এক আল্লাহর ওপর।
তবে একথা সত্য যে, হামলা, মামলা, নির্যাতন, অপপ্রচার, মিথ্যা অভিযোগ, হয়রানি থাকবে কারণ এ অবস্থা সৃষ্টি হলেই প্রকৃত মুমিন চেনা যায়। আল্লাহ বলেন, “এ সময় ও অবস্থাটি তোমাদের ওপর এজন্য আনা হয়েছে যে, আল্লাহ দেখতে চান তোমাদের মধ্যে সাচ্চা মুমিন কে? আর তিনি তোমাদের শহীদ হিসেবে কবুল করতে চান।” (সূরা আল ইমরান : ১৪১)
পরের আয়াতে আল্লাহ বলছেন, “অথচ আমি তাদের পূর্ববর্তীদের সকলকেই পরীক্ষা করে নিয়েছি। আল্লাহ তা’য়ালা অবশ্যই দেখবেন কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যুক।”
আমরা যারা ঈমানের দাবিদার, একটু নিজেকে প্রশ্ন করি, আমরা কি খাঁটি মুমিনদের ন্যায় পরীক্ষার সম্মুখিন হয়েছি? মাত্রাতিরিক্ত চরম জুলুম-নির্যাতনের স্বীকার হয়েছি? মানসিক, দৈহিক নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছি? ব্যবসায়-বাণিজ্য, আয়-রোজগারের পথ কি রুদ্ধ হয়ে গেছে ? পরিবার ও বংশ থেকে কি সম্পর্কচ্ছেদ করতে হয়েছে? একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে পেরেছি? আমাদের প্রিয় জিনিসগুলোকে কুরবান করতে পেরেছি?
আমাদের জানা উচিত, ঈমানের দাবি করলেই প্রতিটি পরতে পরতে পরীক্ষা দিতে হবে। কিন্তু ঈমানের দাবি করে তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কোনো পরীক্ষা দিতে আমরা রাজি নই। সস্তা ঈামানের দাবি করে ঝুঁকি মুক্ত কিছু সস্তা আমলের দ্বারা লোভনীয় জান্নাতে যেতে চাই। আল কুরআন যেখানে ঈামানের কথা বলেছে সেখানেই পরীক্ষার পয়গাম দিয়েছে। তাগুতের অপশক্তি আর মুসলামানদের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মুনাফিকদের শয়তানি ও দুষ্কৃতির কারণে ভেঙে না পড়ে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে। আল্লাহর ওয়াদাকৃত জান্নাত পেতে সদাসর্বদা দুনিয়ার জীবনে ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা দিতে তৈরী থাকতে হবে। ভরসা রাখতে হবে মহান রবের সাহায্যের ওপর। মুমিনরা সব সময় আল্লাহর ওপর ভরসা করেন কারণ বান্দার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
শিক্ষা:
১. মুখে মুখে ঈমানের দাবি করার কোনো মূল্য নেই, কুরবানির মাধ্যমে ঈমানের পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে।
২. আল্লাহ পরীক্ষার মাধ্যমে ঈমানের দাবিদারকে খাঁটি ঈমানদার হিসেবে বাছাই করবেন।
৩. পূর্বেকার সকল নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছে।